শনিবার, ১লা জুলাই, ২০১৭ ইং ১৭ই আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

ভাষা আন্দোলন আমার অহংকার

AmaderBrahmanbaria.COM
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
news-image

---

মহিউদ্দিন আহমাদ : বায়ান্নর আন্দোলনে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা ১৪৪ ধারা জারির কারণে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের গ-গোল হতে পারে এ নিয়ে আমাদের দুঃশ্চিন্তার শেষ ছিল না। আমরা সংগ্রাম পরিষদের ভাষা কর্মীরা বিকেলে নিয়াজ ট্যাংকের (পরে বিলুপ্ত) ঘাটে বসে ঢাকায় কী হতে পারে তা নিয়ে ভাবছি, আলোচনা করেছি। ছাত্ররা কোনো বাধা মানবে না এ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু কী হবে, তা ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। তখন কোনো সংবাদ পাওয়ারও উপায় ছিল না। পরদিন (২২শে ফেব্রুয়ারি) হয়তো পত্রিকায় জানা যাবে এমন ভাবনা নিয়ে ঘরে ফিরি এবং হাজার চিন্তা মাথায় রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। ফজরের আগেই দরজায় ধাক্কা এবং আতঙ্কিত গলাস্বরে ডাকাডাকি। দরজা খুলতেই সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মো. মতিউর রহমান হন্তদন্ত হয়ে এক টুকরা রক্তাক্ত জামার অংশ আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, ঢাকায় গুলি হয়েছে, অনেকে নিহত হয়েছে।’ একথা শুনে স্তম্ভিত, অবাক, কিছুক্ষণ নির্বাক। মনের ভিতর এক ঝড় বইছে। এও কি সম্ভব! সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা, পূর্ববঙ্গে ১৯৪৬ সনের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি, অথচ নতুন রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা স্থান পাবে না এ হতে পারে না, এ মেনে নেওয়া যায় না। দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না এ অঙ্গীকার করে কালবিলম্ব না করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন আমি নিয়াজ পার্কে কাজী আবু জামাল মোক্তার সাহেবের বাসায় লজিং ছিলাম। তিনি ছিলেন বিদ্যাৎসাহী, পরোপকারী, সমাজসেবক, রাজনীতি সচেতন। একসময় তার বাড়িতে শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন গিয়েছিলেন, খেয়েছিলেন এ নিয়ে তিনি গল্প শোনাতেন। তিনি এ সংবাদ শুনে চিৎকার করে উঠলেন, বললেন পাকিস্তান ধ্বংসের পথ বেছে নিয়েছে তোমরা আন্দোলন চালিয়ে যাও, আমরা তোমাদের পাশে থাকব! তার ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর (এ, কে, এম, লুৎফর রহমান ছিল অন্নদা স্কুলের ছাত্র; আমি ছিলাম তার ‘টিউটর’ (উনারা বলতেন মাস্টার সাব)। জাহাঙ্গীর তার ক্ষোভে, দুঃখে, বুক ফাঁটা কান্না শুরু করল। আমি তাকে ভাষা আন্দোলনে একনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম। দেশপ্রেম ছিল অগাধ, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আমার সঙ্গে তার আলোচনা হতো প্রতিদিন। স্টেটসম্যানসহ ইংরেজি, বাংলা পত্রিকা পড়া আমাদের ছিল নিত্য কাজ। কাজী সাহেব বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা রাখতেন এবং নিজে খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন। তার সাহচর্যে এবং প্রেরণায় আমরা দুজনেই ছাত্র রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম। (পরে জাহাঙ্গীর মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারবাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছিলেন এবং শাহাদৎ বরণ করেন; তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি) ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত আমি আর বই ছুঁয়ে দেখিনি, আন্দোলনেই ছিলাম।

ঢাকাতে ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি হয়েছে এ সংবাদ ভোরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা সকালেই কলেজ প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়। প্রতিশোধের সংকল্পের ছাপ সকলের চোখে-মুখে। মতিউর রহমানের অগ্নিঝরা বক্তৃতায় ছাত্রদের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। শুরু হলো শ্রোগান-গগণবিদারী শ্রোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের ফাঁসি চাই’। মতিউরের বক্তৃতায় উজ্জীবিত ছাত্রজনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রোজই চলে মিছিল, মিটিং। শহরের রাস্তার দুপাশে লাইন ধরে চলে মিছিল, মধ্যে চোঙ্গা নিয়ে সামিউল হক খান ফটিক আরও কয়েকজন। মারমুখী মিছিল নিয়ে আমরা গিয়েছি গণপরিষদের সদস্য শহীদুল হকের বাসায়। হাজার হাজার ছাত্রের শ্রোগান বাতাসে কম্পন; শহীদুল হক নেমে আসলেন ছাত্রদের সামনে, মতিউর রাহমান বজ্রকণ্ঠে বক্তৃতা, শোকাহত ছাত্রদের হুংকার, শ্রোগান সবমিলে এক অপূর্ব দৃশ্য। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সমর্থন আদায় এবং ছাত্রহত্যার বিচারের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়। জনাব হককে বেশ নার্ভাস দেখা গেল। অবস্থার গুরুত্ব ও উত্তপ্ত পরিবেশ লক্ষ্য করে তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের জন্য গভীর দুঃখপ্রকাশ করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি সমর্থন করেন। এ দাবি না মানা হলে তিনি পদত্যাগ করবেন এ ওয়াদা আদায় করা হয়; ছাত্ররা কিছুটা শান্ত হয় এবং তার বাসা থেকে বেরিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করেন।

আন্দোলন চলছে, রোজই মিছিল-মিটিং হচ্ছে, শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে ছাত্রহত্যার নিষ্ঠুর কাহিনী ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জনগণ সমর্থন করে মিটিং-মিছিলে যোগ দিচ্ছে। মোহগ্রস্ত বাঙালি মোহমুক্ত হয়ে অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল। ভাষা আন্দোলনের অগ্নিঝঙ্কারে বাঙালি উদ্বুদ্ধ হয়ে যেন সম্বিত ফিরে পেল। শহরের ন্যায় গ্রামেও ফুঁসে উঠছে জনগণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তালশহর ও ভাটপাড়া মফস্বল থেকে প্রতিদিন ছাত্রজনতা মিছিলে যোগ দিত। সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকায় আশেপাশে গ্রামে গিয়ে সভা করেছি। আমাকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যেত আমার ছাত্র, সহকর্মী জাহাঙ্গীর।

আমাদের আহ্বানে বিপুল সাড়া পেয়েছি। যারা আগে নির্বিকার ছিল, তারাও প্রমোদ গুনল যে, বাংলা ভাষার দাবি সফল না হলে এদেশে আমরা চিরবঞ্চিত হয়ে থাকব। তাই, ছাত্রদের সঙ্গে জনতা একাত্ম হয়ে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীগণ যারা নওয়াবদের দ্বারা প্রভাবান্বিত ও সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো, যারা উর্দু বলতে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত, তারাও ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের ফলে সরকারের বিরোধিতা করে বাংলা ভাষার আন্দোলনে যোগ দেয়।

এভাবে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মায়ের ভাষার দাবি আদায়ে সংগ্রামে অটল থাকে। সরকার এ অবস্থা সামাল দিতে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু করে, বেপরোয়াভাবে দমননীতি চালাতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো। এদিকে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা এগিয়ে এলো। নানা কারণে সাময়িকভাবে আন্দোলন স্তিমিত হলেও ছাত্রজনতার মধ্যে যে ঐক্য স্থাপিত হলো, তার ফল ছিল সদূরপ্রসারী। হাতে গোনা মুসলিম লীগ সমর্থক ও নেতৃবৃন্দ ছাড়া সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হুঁশ ফিরে পেল।

১৯৫২ সালের আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। রক্তাক্ত আন্দোলনের স্মৃতি ছাত্রদের মনে জাগরূক। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনের পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছিল। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিতভাবে আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৩ সালে শহিদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি রোজা, ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরী; মিছিল ও বিক্ষোভ এবং জনসভা অনুষ্ঠান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এস এম হল থেকে কাকভোরে খালি পায়ে আমরা ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গনে যাই। অন্যান্য ছাত্রাবাস ও স্থান থেকে হাজার হাজার ছাত্র জমায়েত হয়। শুরু হয় প্রভাতফেরি কণ্ঠে গাজীউল হকের গান ’ভুলব না, ভুলব না সে একুশে ফেব্রুয়ারি’… আজিমপুরে গিয়ে শহিদদের (বরকত ও অন্যান্যদের) কবরে ফুল দিয়ে খালি পায়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে ফিরে আসি। সকলের মনে ক্ষোভ, হৃদয়ে দারুণ ব্যথা, চোখে-মুখে সংকল্পÑ ‘দাবি’ আদায় করতে হবে।

আসছে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন। প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ; মুসলিম লীগকে হটাতে হবে। গঠিত হলো যুক্তফ্রণ্ট। দলমত নির্বিশেষে সকলেই যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করে। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব তাদের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রণ্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করল। ২৩৭টি মুসলিম আসনে ২২৮টিতে মুসলীম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। মন্ত্রীগণ পরাজিত হলো, অনেক প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হলো, এর মূলে ছিল ভাষা আন্দোলনে গণজাগরণ। যুক্তফ্রণ্ট সরকার গঠিত হলো, হাল ধরলেন শেরে বাংলা। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার ১১ বছর পর ৮১ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে ৩ এপ্রিল বিভক্ত বাংলার (পূর্ববঙ্গের) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ২১ দফা বাস্তবায়ন শুরু করলেন। অগ্রাধিকার দিয়ে যে পদক্ষেপ নিলেন তার মধ্যে ছিলÑ

১.     একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা;

২.     মেডিকেল হোস্টেলে শহিদ মিনার নির্মাণ;

৩.     পহেলা বৈশাখ ছুটি ঘোষণা;

৪.     বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি ঘোষণা;

৫.     বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা;

৬.     সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা।

ধাপে ধাপে ভাষা আন্দোলনের সাফল্য অর্জিত হলো। ১৯৫৬ সনে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৯ বছরেও সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হয়নি। পরে শেরে বাংলা কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার বলিষ্ঠ ভূমিকায় বাংলা ভাষার দাবি মেনে ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ সংবিধান কার্যকর করা হয়। ওইদিন রাতে আলোকসজ্জাও উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করছিল। এতদসত্ত্বেও দেশে ষড়যন্ত্রের শেষ হয়নি। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলো, মৌলিক অধিকার হরণ করা হলো, নির্বাচিত সরকার সরিয়ে পূর্ববঙ্গকে দাবিয়ে রাখার চক্রান্ত হলো। কিন্তু শোষকের দল বুঝতে পারেনি যে, ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে, অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়াতে শিক্ষা দিয়েছে। তাই, কোনো ষড়যন্ত্রই তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

আজ মহান একুশে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে উদ্যাপিত হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৭০০ ভাষা থেকে আর কোনো ভাষা হারিয়ে না যায় এ লক্ষ্যে ইউনেস্কো কাজ করছে। বুকটা গর্বে ফলে উঠে, বাংলা ভাষা আজ সারাবিশ্বে সমাদৃত, সম্মানিত। তাই, ভাষা আন্দোলন আমাদের সবার গর্ব, সবার অহংকার।

লেখক : ভাষা সৈনিক ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ

এ জাতীয় আরও খবর