বুধবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৮ ইং ১৮ই মাঘ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

নবাবকে স্মরণই করে না ঢাবি, ঢামেক ও বুয়েট !

দেশসেরা তিন বিদ্যাপীঠ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য শুধু শত শত একর জমিই নয়, নিজের শ্রম ও মেধা দিয়ে গেছেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। অথচ ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে এখন আর স্মরণ করে না তিনটি প্রতিষ্ঠান।

এমনকি সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে ১৬ জানুয়ারি নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যু বার্ষিকীতে সামান্য কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান, দোয়া-মিলাদ কিংবা স্মরণ সভা করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক নেটিজেন।

পরিবর্তন ডটকমের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও বিস্ময়কর বাস্তবতার চিত্র মিলেছে। স্মরণ-শ্রদ্ধা জানানো তো দূরের কথা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের মনেই নেই নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম কিংবা মৃত্যুদিন। কেউ আবার তার অবদানের কথাই জানেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো ১৬ জানুয়ারি। তার দান করা ৬০০ একর জমির উপর আজকের ঢাবি, ঢামেক ও বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে আছে।

অথচ ক্ষণজন্মা এই শিক্ষাহিতৈষী ব্যক্তিত্বের মৃত্যুবার্ষিকীতে এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো স্মৃতিচারণামূলক অনুষ্ঠান কিংবা দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি।

আকিজ গ্রুপের কর্মকর্তা রুহুল আমিন তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন, তৎকালীন সময়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঙালি-বিদ্বেষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কথা কমবেশি সবারই জানা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শুধু কঠোরভাবে বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে রীতিমতো দেন-দরবার করেছিলেন যাতে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করা হয়। সেসময় রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন, ‘মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়, তারাতো ঠিকমতো কথাই বলতে জানে না!’ অন্যত্র এক অনুষ্ঠানে এদেশের মানুষকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ অথচ সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন, মৃত্যুদিন, সাহিত্য উৎসবসহ আরও অনেক আয়োজন ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।

রুহুল আমিন তার স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আর যে বঙ্গসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার সেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে আজকের শিক্ষার্থীদের অনেকেই চেনাতো দূরের কথা নামটাও জানে না। আমরা এতোটা অকৃতজ্ঞ যে বলতেও লজ্জা লাগে!

এইচএম শাহি লিখেছেন, আজকাল রাজনীতিবিদদের জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকী যেভাবে ঘটা করে পালন করা হয় আর নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মতো প্রগতিশীল, মহৎ ব্যক্তিকে আমরা স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করি। আসলে এটা আমাদের হীনমন্যতার পরিচয়।

নজরুল চৌধুরী দিদার ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ধিক্কার জানাই এমন অন্ধ, অকৃতজ্ঞ গুণী ও চেতনাধারীদের।

যোগাযোগ করা হলে ঢামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ অনেকটা বিম্ময় প্রকাশ করেছেন। ঢামেক প্রতিষ্ঠায় তিনি নবাব সলিমুল্লাহর অবদান সম্পর্কেই জানতেনই না।

পরিবর্তন ডটকমকে তিনি বলেন, সোমবার অফিসে গিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নবাবের অবদান বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবেন। তারপর একটি স্মরণসভার আয়োজন করবেন।

অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, এমন হয়ে থাকলে অবশ্যই গুণী মানুষদের তাদের সম্মান দেয়া উচিত।

তিনি জানান, মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা আছে। সেখানে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবেও তিনি বিষয়টি সবার সঙ্গে আলাপ করবেন।

জানতে চাইলে ঢাবি উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিষয়ে তার অবগত না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সব মিডিয়ার সব খবর সব সময় নজরে আসে না।

তবে নবাব সলিমুল্লাহকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করা দরকার বলে তিনিও মনে করেন। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান ঢাবি উপাচার্য।

একনজরে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ

নবাব সুলিমুল্লাহ ১৮৭১ সালের ৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রিয়। ফলে অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করতেন। সাধারণ মানুষের দুঃখকে তিনি নিজের দুঃখ মনে করতেন। তিনি আকাতরে দান-খয়রাত করতেন।

নবাব সলিমুল্লাহ সর্বপ্রথম পানীয় জল, ইলেক্ট্রিসিটি এবং টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আধুনিক ঢাকার জন্ম দেন।

জীবনের প্রথম দিকে জনগণের কথা চিন্তা করে নবাবীর লোভ না করে মোমেনশাহীর ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি ১৯০৩ সালে বড় লাট লর্ড কার্জন ঢাকায় সফরে এলে তার নিকট পূর্ব বাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।

নবাব সলিমুল্লাহ ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীকে নিয়ে পৃথক দুটি মানপত্র নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ঢাকার রমনা এলাকায় নিজ জমি দান করেন। বাবার নামে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমানে বুয়েট) প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রসঙ্গত ১৯০৬ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দোসরদের ক্রমাগত আক্রমণ থেকে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ধর্ম রক্ষায় প্রায় ছয় মাসের প্রচেষ্টায় পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয়। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।

নবাব সলিমুল্লাহর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শিক্ষা বিভাগে মুসলমানদের জন্য সহকারী পরিদর্শক ও বিশেষ সাব-ইন্সপেক্টরের পদ সৃষ্টি করা হয়।

এছাড়া ১৯০৫ সালে বঙ্গকে দুই ভাগে ভাগ করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও আসাম নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। যদিও স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ।

নবাব সলিমুল্লাহ মানুষের জন্য তার ধন-সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দেন। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় অনেকটা রহস্যজনক মৃত্যু হয় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর।