মঙ্গলবার, ২৯শে মে, ২০১৮ ইং ১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

চড়ুই সম্পর্কে কিছু কথা

পরিবেশের অবনতির সঙ্গে ধীরে ধীরে আমাদের বাড়ির আশপাশ থেকে ক্রমেই কমে যাচ্ছে এই ছোট্ট বন্ধুদের উপস্থিতি। এই বন্ধুদের জীবন যাতে আর বিপন্ন না হয়, তার জন্যে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে নানা কর্মযজ্ঞ। হাউস স্প্যারো বা গৃহস্থালি চডুই সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্যেই বেছে নেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ দিন… ২০ মার্চ। অর্থাত্‍ আজ বিশ্ব চড়ুই দিবস।

সারা পৃথিবী জুড়ে নানা রকমের চড়ুই পাখি রয়েছে। প্রজাতিভেদে এদের আকারও হয় ভিন্ন। সাধারণত চড়ুইয়ের দৈর্ঘ্য ১১ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। এদের ওজন ১৩.৪ গ্রাম থেকে ৪২ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। কখনো কখনো একসঙ্গে অনেক চড়ুই দেখা গেলেও এরা কখনোই দল তৈরি করে বসবাস করে না।

বাড়ির বারান্দা বা ছাদে হামেশাই ছোট্ট ছোট্ট এই পাখি বন্ধুদের দেখে থাকি। তবে জানেন কি এদেরও নানা নাম, নানা পরিচয় আছে, ঠিক আমার আপনার মতোই? আজ বিশ্ব চড়াই দিবসে আসুন জেনে নেওয়া যাক তাদের সম্পর্কে।

দুই বাংলার বিভিন্ন অংশে দেখা যায় গৃহস্থালি চড়ুই (House Sparrow)। এর বৈজ্ঞানিক নাম : Passer domesticus। দুই বাংলায় চড়ুইয়ের স্ত্রী পাখির গায়ের রঙ ধূসর এবং পিঠের দিকের রঙ খানিক গাঢ় হয়। পুরুষ পাখির ডানার রঙ হয় বাদামি। গাল সাদাটে হয় এবং ঠোঁটের নিচের দিক কালো বর্ণের হয়। সাধারণত এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার। ওজনও ৪০ গ্রামের আসপাশেই হয়।

পৃথিবীতে মোট ৪৮ প্রজাতির চড়ুই দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু প্রজাতি হচ্ছে- আব্দ আল-কুরি চড়ুই, আয়াগো চড়ুই, আরবীয় সোনালী চড়ুই, ইউরেশিয়ান বৃক্ষ চড়ুই, ইতালিয়ান চড়ুই, উত্তরাঞ্চলীয় ধূসর-মুণ্ডু চড়ুই, কেনিয়া চড়ুই, কেপ চড়ুই, কোর্ডোফান চড়ুই, গৃহ চড়ুই, চেষ্টনাট চড়ুই, টিয়া-ঠোঁট চড়ুই, দক্ষিণাঞ্চলীয় ধূসর-মুণ্ড চড়ুই, প্লেন-ব্যাকেট চড়ুই, বড় চড়ুই, মরু চড়ুই, মৃত সাগরের চড়ুই, রুসেট চড়ুই, শেলি চড়ুই, সাক্সাউল চড়ুই, সিন্দ চড়ুই, সুদানি সোনালী চড়ুই, সোকোত্রা চড়ুই, সোমালি চড়ুই, সোয়াইনসোন’স চড়ুই, সোয়াহিলি চড়ুই, স্প্যানিশ চড়ুই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর জাহান সরকার ২০১৫ সালে দেশের একটি পত্রিকায় চুড়ই পাখির উপকারিতা নিয়ে এক লেখায় জানান, ‘চড়ুই আমাদের কতখানি উপকার করে তা উপলব্ধি করতে একটি বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করছি- ঘটনাটি চীনের। চড়ুই ফসলের ক্ষেতের সর্বনাশ ডেকে আনে ভেবে ১৯৫৮ সালে মাও-সে-তুং এর নির্দেশে অসংখ্য চড়ুই নিধন করা হয়। কেননা একটি চড়ুই বছরে ৪ থেকে ৫ কেজি শস্য খায়। সুতরাং, দশ লক্ষ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচিয়ে প্রায় ৬০ হাজার ব্যক্তির খাদ্যের জোগান দেয়া যেতে পারে। অতএব শুরু হল প্রচারণা। রাতারাতি তৈরি হল ১ লাখ রঙিন পতাকা। চড়ুই মারার উৎসবে মেতে উঠল গোটা দেশ।sparrow army কাজে লেগে গেল। পুরস্কার ঘোষণা করা হল চড়ুই মারার জন্য। বিভিন্ন পদ্ধতিতে চড়ুই নিধন হতে লাগল। যেমন- খুব জোরে জোরে ড্রাম বাজাতেই চড়ুই উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। ডিম নষ্ট করা হল। তছনছ করা হল বাসা। জাল দিয়ে ধরা হল অসংখ্য চড়ুই। বন্দুক দিয়ে মারা হল বাকি চড়ুই। এভাবে ‘The great sparrow campaign’ নামে প্রচারণার মাধ্যমে চড়ুইশূন্য হল চীন। চীন থেকে চড়ুই হয়ে গেল বিলুপ্ত।

১৯৬১-৬২ সাল। চীনে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। মারা গেল প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মানুষ। ফসলের ক্ষেতে বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ এমনভাবে বেড়ে গেল যে ক্ষেত থেকে ফসল আর ঘরেই তোলা গেল না। দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর মিছিল। টনক নড়ল দেশটির সরকারের। নিরুপায় হয়ে প্রকৃতিতে চড়ুই ফিরিয়ে দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু হল চড়ুই আমদানি।’

ইদানীং মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে পৃথিবী থেকে চড়ুই পাখি হ্রাসের হার অত্যন্ত ঊর্ধ্বগতি। অথচ পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার জন্যে প্রত্যেক প্রাণীর উপস্থিতিই একান্ত জরুরি। আসুন না বাড়িয়ে দিই ছোট্ট সাহায্যের হাত। বিশেষ কিছু করতে না পারলেও, এই তীব্র গরমের সময়ে ছোট্ট বন্ধুদের জন্যে বারান্দায় বা ছাদের এক কোণে রেখে দিন না পানির পাত্র… তারা পাঁচ সেকেন্ডের গোছলই করুক বা ভিজিয়ে নিক ঠোঁট…

Print Friendly, PDF & Email