মঙ্গলবার, ২৯শে মে, ২০১৮ ইং ১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

বাংলা নববর্ষ এবং কিছু কথা-কায়ছার আলী

“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর” প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন ফুলে-ফলে, শস্য-শ্যামলে, সৌন্দর্যে-সমারোহে, লীলা বৈচিত্রে, রূপ লাবণ্যে ভরা আমাদের প্রাণ প্রিয় মাতৃভুমি। বছরের বিভিন্ন সময়ে অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনে হয় বিধাতা যেন সমন্ত সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন। অসাধারণ সৌন্দর্য দেখে মোঘল আমলে এমন কি প্রাচীন কালেও সীজার, ফ্রেডারিক, বার্নিয়ের, ইবনে বতুতা ও টেভানিয়ার প্রমুখ বৈদেশিক পর্যটকগণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। এদেশে ছয়টি ঋতু নিরন্তর চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলছে। লীলাময়ী প্রকৃতি এখানে মুক্ত হস্তে সৌন্দর্য বিতরন করছে।

তাই এ দেশকে প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতন বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দ আজ না থাকলেও ডিজিটাল ঘড়িতে প্রতি মুহূর্তে ভেসে আসছে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা। বহতা নদীর মত বয়ে চলছে সময়, কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। আজ ১লা বৈশাখ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। শুভ বাংলা নববর্ষ। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বহমান প্রাচীন ধারা। বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালির প্রাণের উৎসব আয়োজন যেন এক সুত্রে বাধা। পুরাতনকে পিছনে ফেলে নিজ ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিকে বক্ষে ধারণ করে নতুন বর্ষকে বরণ করতে উদগ্রীব সারা বিশ্বের বাঙালি প্রাণ। তাই বাঙালির সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক মহোৎসব কিভাবে এবং কেন এলো তা আমাদের জানতে হবে। ইতিহাস থেকে জানা যায় ভারত বর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবী বছর হিজরী পুঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন।

কিন্তু হিজরী সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কৃষি ফলনের সাথে এর কোন মিল পাওয়া যেত না। আর তখনই সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষ পুঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করেন। সম্রাট এর আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফয়েজ উল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবী হিজরী সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরীর কাজ শুরু করেন। বাংলা বছর নির্ধারন নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৫৮৪ খ্রিঃ ১০ বা ১১ ই মার্চ থেকে বাংলা সন গননা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এই গননা পদ্ধতিকে কার্যকর করা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর। অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলী সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে।

এভাবে বাংলা সনের জন্ম লাভ ঘটে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ৯৬৩ হিজরীর বাংলা বৈশাখ মাসের সাথে সামঞ্জস্য থাকায় তার সাথে মিল রেখে ৯৬৩ বঙ্গাব্দের সূচনা করা হয়। ওহ্ ! বাংলা মাসের নামকরণ কিভাবে এলো তা লিখতে ভুলে গেছি। বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেয়া হয়েছে। যেমন : বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবনা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মষা থেকে মাষ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।

সম্রাট আকবরের সময়ে মাসের প্রত্যেকটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম প্রচলিত থাকায় জনসাধারণের মনে রাখা খুবই কষ্ট হত। পরবতীতে সম্রাট শাহাজাহান সাত দিনের সপ্তাহ ভিত্তিক বাংলায় দিনের নামকরণের কাজ শুরু করেন। ইংরেজি সাত দিনের নামের সাথে কিছুটা আদলে বাংলায় সাত দিনের নামকরণ করা হয়। যেমন- সানডে রবিবার। সান অর্থ রবি বা সূর্য আর ডে অর্থ দিন। এভাবে বর্ষ গণনার রীতিকে বাংলায় প্রবর্তনের সংস্কার শুরু হয় মোঘল আমলে। বর্তমানে বহির্বিশ্বের সাথে বাঙালিদের যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন রাখার সুবিধার্র্থে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই খ্রিষ্টীয় সন ব্যবহার করা হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত পঞ্জিকা অনুসারে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়। বাংলা দিন পঞ্জির সাথে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। তা হল হিজরী সাল চাঁদের সাথে আর খ্রিস্টীয় সাল চলে ঘড়ির সাথে। এ কারণে হিজরী সনের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনের মধ্যে দিয়ে, ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্য রাতে আর বাংলা সনের শুরু হয় ভোরের সূর্য উঠার সাথে সাথে। প্রাচীন আরবে “ওকাজ মেলা” ইরানীদের “নওরোজ উৎসব” এবং প্রাচীন ভারতীয়দের “দোল পূর্নিমা” কোরিয়ানদের “সোল-নাল” আর সমস্ত বাঙালিদের “পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ ” (সামাজিক উৎসব) সবার অন্তরে অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দে মাতোয়ারা করে সবাইকে একাকার করে দেয়। বর্ষবরণের মূল আয়োজন ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হলেও সেই আনন্দ আয়োজনের ঢেউ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

পান্তা, ইলিশ আর নানার রকম ভর্তার বাঙালিপনায় পুরোজাতি নিজেকে খুঁজে ফিরে বর্ষবরণের ব্যস্ততায়। সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী ও ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মিলিত কন্ঠে গান, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের শোভাযাত্রা, মঙ্গলযাত্রা, নানা রকম বাদ্য যন্ত্র, বিভিন্ন প্রানীর প্রতিলিপি ও রং বেরঙের বানানো মুখোশ, শাড়ি, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশনা, বিটিভিসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল অনুষ্ঠানমালা সরাসরি সম্প্রচার করে দেশ ও দেশের বাইরের সকল বাঙালিদেরকে একটি সুতোর মালা দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। সরকারি ছুটির দিন থাকায় কর্মজীবী ও পেশাজীবীরা তাদের পরিবার, পরিজন নিয়ে বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহন করছে, মজা করছে। কোটি কোটি বাঙালির আজ আনন্দ বা বিনোদনের শেষ নেই। বরফের মত সময় ধীরে ধীরে গলে শেষ হয়ে যতই যাচ্ছে, ততই আগামী বছরের বর্ষবরণের প্রতীক্ষা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আজ ভোরের সূর্য উঠার সাথে সাথে সঙ্গীত শিল্পীরা পহেলা বৈশাখকে গানে গানে, সুর ও সঙ্গীতের মূর্ছনায় স্বাগত জানিয়ে যেভাবে বর্ষ বরণ করে নিল তা একটি মাইলফলক হয়ে রইল। আগামী বছরে ঠিক এভাবেই যেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী গানটি আবার সম্মিলিতভাবে গাইতে পারি, এ আশায়।

“এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো……জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

01717-977634, [email protected]

Print Friendly, PDF & Email