বৃহস্পতিবার, ২১শে জুন, ২০১৮ ইং ৭ই আষাঢ়, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

১০ বছর ধরে মাদক ব্যবসায়ীদের নৃশংস হামলার ক্ষত সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা আবু সরোয়ারের দেহে

প্রায় ১০ বছর আগে মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের দ্বারা যে নৃশংস হামলার শিকার হন বর্তমানে পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা মো. শহীদ আবু সরোয়ার, সে হামলার ভয়াবহ ক্ষতের পীড়া তিনি ভোগ করছেন আজও। তার ডান হাতের দুটো হাড়ে ৬টি করে ১২ স্ক্রু ও দুটো প্লেট লাগানো।

২৪ তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে কর্মরত আছেন কুষ্টিয়ার ইন সার্ভিস ট্রেইনি সেন্টারে।

আমাদের সময় ডটকমকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে তখন ওই অপারেশন পরিচালনা করেছিলাম। মৃত্যু কী জিনিস তখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম। ঘটনা সম্পর্কে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেন আবু সরোয়ার।

২০০৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ৯ এর সদর দপ্তর সিলেটে অপারেশন অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এমন পবিত্র রমজান মাসেই তিনি সোর্সের মাধ্যমে খবর পান সিলেটের বিশ্বনাথ ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মাঝামাঝি একটি গ্রামে হেরোইনের বড় স্পট আছে। ভাড়ায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে সেদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্রেতা সেজে হেরোইনের তালাশ করেন তার নেতৃত্বাধীন র‌্যাব সদস্যরা। কিন্তু পাওয়া যায়নি।

ইফতারের ঠিক আগ মূহুর্তে সেই সোর্সই ফোন করে জানান, বিপুল পরিমাণ মদের তথ্য। সে অনুযায়ী- সে গ্রামের কোমর পানিতে প্লাবিত একটি ধান ক্ষেত থেকে ছোট ছোট তিন বস্তা প্রেসিডেন্ট চয়েস ব্র্যান্ডের মদ উদ্ধার করা হয়, এসময় একজনকে গ্রেপ্তার করে হ্যান্ডকাফও পরানো হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামবাসীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে র‌্যাব সদস্যদের দিকে। এসময় বড় একটি ইটের খণ্ড সরোয়ারের বুকে লাগে।

ব্যক্তিগত নাইন এমএম পিস্তল দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ইচ্ছে থাকলেও বুকে আঘাতের কারণে পারছিলেন না তিনি। এরপর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, সেনাবাহিনীর সৈনিক হান্নানকে নির্দেশ দেন তার অস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই অস্ত্রও কাজ করেনি। ততক্ষণে গ্রামবাসীর আক্রমণ বাড়তে থাকে। অবস্থা খারাপ দেখে আবু সরোয়ারকে ছেড়ে সব র‌্যাব সদস্য ও সোর্স পালিয়ে যায়। এসময় পাশের একটি ঝোঁপ থেকে রড দিয়ে সরোয়ারের মাথায় একজন সজোরে আঘাত করে। এরপরও আরও আঘাত তিনি ডান হাত দিয়ে ফেরাতে চেষ্টা করলে ডান হাত ভেঙে দুই হাড় বেরিয়ে পড়ে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন উত্তেজিত গ্রামবাসীও তাকে আক্রমণ করে বসে। এক পর্যায়ে একজন গ্রামবাসী বলে উঠে তাকে মারা হচ্ছে কেন। কিন্তু লাভ হয়নি।

সরোয়ারকে নেয়া হয় একটি অন্ধকার কক্ষে। সেখানে তার বা চোখে আঘাত করা হয় এবং চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টাও করা হয়। মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া হয়, আইডি কার্ড রেখে দেয়া হয়। কিন্তু সরোয়ার অনুরোধ করেন- যাতে আইডি কার্ড ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং একজন শিক্ষিত কাউকে দিয়ে এটা পড়ানো হয়, যাতে সবাই বুঝতে পারেন তিনি কে। তারপরও কোনো সুবিধা হয়নি।

দুই কন্যা ও এক পুত্রের জনক সরোয়ার এ প্রতিবেদককে বলেন, রডের আঘাতের পর যখন মাটিতে পড়ে গেলাম, তখন মনে হচ্ছিল- আর বাঁচব না। আমি খোদার নাম স্মরণ করি, মা-বাবাকে স্মরণ করি। আমাদের ব্যাকাপ মাইক্রো বাসটিকে দেখার চেষ্টা করছিলাম।

ঘরে আটকে থাকা অবস্থায় সরোয়ার তার র‌্যাব টিম সদস্যদের সরব উপস্থিতি পান। পুরো এলাকাটিই মাদকে আক্রান্ত এবং প্রচুর মাদক ব্যবসায়ীদের বসবাস ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারপরও আমি গুলির নির্দেশ দেইনি। উত্তেজিতদের প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছিল- তারা আমাকে মেরে ফেলবে। যদি আমার টিমকে গুলির নির্দেশ দিতাম, তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটার আশঙ্কা ছিল। এক পর্যায়ে টিমের শক্ত পদক্ষেপের কারণে আমি মুক্ত হই।

ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সরোয়ারকে নেয়া হয় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা করে বাম চোখ ও মাথায় সেলাই করা হয়। দুদিন পর নেয়া হয় ঢাকার ট্রমা সেন্টারে। সেখানে তার ডান হাতে অপারেশন করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আফম রুহুল হক।

সরোয়ার বলেন, ট্রমা সেন্টারে র‌্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হাছান মাহমুদ খন্দকার স্যার আমাকে স্বপরিবারে দেখতে এসেছিলেন। স্যার সব সময় আমার খোঁজখবর নিতেন।

২০০৬ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে র‌্যাব সদর দপ্তরে সংযুক্তিতে পাঠানো হয় সরোয়ারকে। সেখান থেকে র‌্যাব ৯ সিলেটে প্রথমে সহকারী পরিচালক এবং পরে অপারেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

ওই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছিল, বিশ্বনাথ থানায় মাদক আইনে এবং জগন্নাথপুরে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার মামলা। বছর খানেকের মধ্যে তিনি পেশাগত ও পারিবারিকভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার এক মেয়ে জন্মগতভাবে বাক প্রতিবন্ধী। এই মেয়ের পেছনেও অনেক সময় দিতে হয় সরোয়ারকে। এজন্য মামলার খবর আর নিতে পারেননি। মাঝে একবার হাজিরা দিয়ে একজন আসামি সনাক্ত করেছিলেন আদালতে। ঘটনার পর তিনি দুইবার জাতিসংঘের শান্তি মিশনেও ছিলেন।

তিনি বলেন, হাতে স্ক্রু, প্লেট লাগানো থাকায় ভারী কাজ থেকে বিরত থাকি। মাঝেমধ্যে ব্যথাও হয়। সরোয়ার বলেন, বর্তমানে সরকার মাদকবিরোধী যে অভিযান শুরু করেছে, তা যেন সফল হয়। আমি মনে প্রাণে কামনা করি।

জুনিয়র পুলিশ সদস্যদের প্রতি তার পরামর্শ- পদ-পদকের দিকে না তাকিয়ে দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ ধারণ করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে উৎসাহী হতে হবে। কুষ্টিয়ায় আসার পূর্বে তিনি যশোরে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্বে।

Print Friendly, PDF & Email

এ জাতীয় আরও খবর