সোমবার, ১৫ই অক্টোবর, ২০১৮ ইং ৩০শে আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

সেই কোহিনূরের ফাঁসি

নয় বছর আগের ঘটনা। নানাজনের সঙ্গে পরকীয়ায় মত্ত কোহিনূর বেগম সৌদি প্রবাস ফেরত স্বামী মো. শাহজাহান খানকে গলা কেটে হত্যা করে তার প্রেমিকদের নিয়ে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রায় হয়েছে মঙ্গলবার। এতে স্ত্রী কোহিনূর বেগমসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক শেখ সুলতানা রাজিয়া।

স্ত্রী কোহিনূর ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন- নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামের আবুল খায়ের (আবুইল্লা), গোলাপ মিয়া ও দোহা ওরফে দুইখ্যা। এদের মধ্যে আবুল খায়ের ছাড়া বাকি সবাই পলাতক রয়েছে। এ মামলায় মোখলেছুর রহমান ও আল আমিন নামে অপর দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১৩ই নভেম্বর আমতলি গ্রামের আবদুল বারেক খানের ছেলে সৌদি আরব প্রবাসী মো. শাহজাহান খান ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন।

এরপর থেকে স্ত্রী কোহিনূরের সঙ্গে তার পরকীয়া নিয়ে মনোমালিন্য চলতে থাকে। ওই বছরের ২রা ডিসেম্বর রাতে তিন সন্তানকে নিয়ে নিজ ঘরের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন শাহজাহান। হঠাৎ রাত ১২টা থেকে একটার মধ্যে শাহজাহানের ঘরে চিৎকারের শব্দ শুনে বাবা বারেক খান ঘরে গিয়ে বিছানায় শাহজাহানের গলাকাটা মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। নিহত শাহজাহান এ ঘটনার ২০ দিন আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। আর ঘটনার দু’দিন আগে ঈদ করার জন্য বউ বাচ্চা নিয়ে আশুগঞ্জের ভাড়াটিয়া বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি আমতলীতে যান। এ ঘটনায় ৩ ডিসেম্বর কোহিনূরকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা করেন বারেক খান। এ হত্যা ঘটনার পরই পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করে কোহিনূরকে। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় আবুইল্লা ওরফে আবুল খায়েরকে। কোহিনুর হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবিন্দ দেন। পরবর্তীতে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
কোহিনূরের সেই স্বীকারোক্তি: নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দোহার সঙ্গে আমার প্রেম হয়। আমার বিয়ে হওয়ার পর ‘ও’ পাগল হয়ে যায়। বিয়ের দুই মাস পরই আমার স্বামী বিদেশে চলে যায়। আমি পিত্রালয়েই থাকতাম। তখন তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতো। স্বামী দুই বছর পর পর দেশে আসত। মাস দুয়েক থেকে আবার চলে যেত। এর মধ্যে বছর দেড়েক আগে আশুগঞ্জে বাসা ভাড়া নিই। সে ওখানে আসত বা ফোনে যোগাযোগ করতো। গত ১৩ই নভেম্বর প্রবাস থেকে আমার স্বামী দেশে ফিরে আসে। ঈদ করার জন্য আমরা গ্রামের বাড়ি আমতলিতে যাই। ঘটনার দুই দিন আগে সে আমাকে বলে একদিনের জন্য হলেও আমি তোমারে বিয়ে করুম। সে সব সময় আমারে বুড়া বেডার বউ বলে ডাকত। আমারে বলে বুধবার রাতে দরজা খোলা রাখবা। আমি স্বামীকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। দরজা খোলা রাখি। সে এসে আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বলে কি আছে দে, আজকে কোনো ভালোবাসা নেই। যা আছে দে। আমি তখন ঘরে জ্বালানো চকেট লাইটের আলোতে অন্য দু’জনকে দেখতে পাই। তাদের একজন আবুল। আবুল আমার স্বামীর মাথা চেপে ধরে। সে গলায় ছুরি চালায়। কোহিনূর জবানবন্দিতে আরো বলে, দরজা খোলা রেখেছিলাম সে আসবে বলে। সে যে আমার স্বামীকে মেরে ফেলবে তা বুঝতে পারিনি। মনে করেছিলাম টাকা পয়সা নিয়ে যাবে।

বেপরোয়া কোহিনূর: আমতলী গ্রামের কোহিনূরের শ্বশুর বাড়িতেই রাত বিরাতে আসত তার প্রেমিকরা। পার্শ্ববর্তী কিশোরপুর (টানচক) গ্রামের এক যুবক আসত তার ঘরে। আসত জালশুকার আরেক প্রেমিক মোখলেছ। তাদের অবাধ যাতায়াতে বাধা দেয়ায় শ্বশুর হাজী আবদুল বারেক খান ও দেবর আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কোহিনূর নারী নির্যাতন মামলা দেয়। এই মামলার সাক্ষী হয় আবুইল্লা ওরফে আবুল খায়ের। রোকেয়া নামের আরেক মহিলাকে স্বর্ণের কানের দুল দিয়ে সাক্ষী করানো হয়। এই ঘটনার পরই কোহিনূর স্বামীকে বুঝিয়ে আশুগঞ্জে বাসা ভাড়া নেয়। শাহজাহান হত্যার পরই কোহিনুরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তার দেবর আইয়ুব তখন সাংবাদিকদের জানান- তার এখানে ছেলেপেলেরা আসায় গ্রামের লোকজন আমাদের মন্দ বলতো। বলতো তোদের বাড়িতে কি চলে? আশুগঞ্জে যাওয়ার পরই অবাধ চলাচলের আরো সুযোগ হয় কোহিনূরের। আশুগঞ্জে প্রথমে তারা বাসা ভাড়া নেয় পানিশ্বর বিল্ডিংয়ে। এক বছর পর বাসা ছাড়ার নোটিশ দেয় মালিক। এরপর বাসা ভাড়া নেয় কলাবাগানে। কোহিনূরের সঙ্গে আশুগঞ্জের বাসায় থাকত তার ভাগ্নি তৌহিদা আক্তার। তৌহিদা জানায়, মোখলেছ নামের ওই ছেলে আশুগঞ্জের বাসায় যেত। মাঝে মধ্যে রাতে থাকত। ৭-৮ দিন পরপরই সে যেত। আবার কোহিনূরও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোখলেছের ওষুধের দোকানে যেত। কোনো কোনো সময় রাতে ফিরতোও না। তৌহিদা জানায়, কোহিনূর সারা দিনই বাসার বাইরে থাকতো। আর বাচ্চারা থাকত আমার কাছে। মোখলেছ ছাড়া আবুইল্লাও যেত আশুগঞ্জের বাসায়। হত্যা মামলায় জামিন পাওয়ার পর কয়েক মাস গ্রামের বাড়ি জালশুকাতেই ছিল কোহিনুর। এরপর শহরে চলে আসে। বছর খানেক আগে থেকেই তার দেখা পাচ্ছেন না গ্রামের মানুষ। কোহিনুর জালশুকা গ্রামের ধন মিয়ার মেয়ে। সূত্র: এমজমিন