বুধবার, ২৪শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ৯ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

ব্যক্তিজীবনে এত ভালো মানুষ ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু! স্যালুট না জানিয়ে পারবেন না

গিটারিস্ট ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এলআরবি (লাভ রানস ব্লাইন্ড) ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে হয় না। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্যান্ড সঙ্গীতের মধ্যমণি ছিলেন ‘এবি’।

আশি ও নব্বই দশকের সময়টাতে রক গানের মাধ্যমে তিনি প্রভাব ফেলেছেন কিশোর-তরুণদের মনে। সে প্রভাব এতটাই গভীর যে, সেসময়ের কিশোর-তরুণরা, যারা এখন মা-বাবা হয়ে গেছেন, এখনও সেইসব গানে বিভোর হয়ে ফিরে যান ফেলে আসা অতীতে। কিন্তু এই যে হৃদয়ে কড়া নাড়া ব্যান্ড তারকা, ব্যক্তিজীবনে ঠিক কেমন ছিলেন তিনি?

রক মিউজিকের অঙ্গনে সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকবেই। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের মাইলস এবং কলকাতার ফসিলস্ ব্যান্ডের মধ্যেও চলেছিল কাঁদা ছোড়াছুড়ি। কিন্তু বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আইয়ুব বাচ্চু এক্ষেত্রে ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সাবেক সহশিল্পীদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন সবসময়।

১৯৭৮ সালের দিকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ড গান করত। এই ব্যান্ডের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেন বাচ্চু। ১৯৮০ সালে যোগ দেন ‘সোলস’ ব্যান্ডে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর সেখানে লিডগিটার বাজান। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল গড়ে তুললেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। কিন্তু এরপরও এক সময়ের ফিলিংস ও সোলস ব্যান্ডের তারকা শিল্পীদের সাথেও একাধিক যৌথ অ্যালবামের কাজ করেছেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে এত ভালো মানুষ ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু! স্যালুট না জানিয়ে পারবেন না

হাসান ও জেমসের সাথে আইয়ুব বাচ্চু

ব্যান্ড ভাঙনের পর শিল্পীদের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যতিক্রম। একসময় এলআরবি ব্যান্ডের কি-বোর্ডিস্ট ছিলেন এসআই টুটুল। তার স্ত্রী অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদ ছিলেন এলআরবি’র ঘনিষ্টজন এবং বাচ্চুর একনিষ্ট ভক্ত। আমেরিকা ট্যুরে সরাসরি এলআরবির সান্নিধ্যে আসেন তিনি। সেসময় তার সাথে আলাপ শুরু করেন টুটুল। পরে সলো গানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করা টুটুল ব্যান্ড ছেড়ে চলে যাবার পরও নিজের বিয়েতে অতিথি হিসেবে পেয়েছিলেন ‘বাচ্চু ভাই’কে।

রক মিউজিকে বেশিরভাগ তারকাকে হরহামেশাই অহংকারী ভূমিকায় দেখা যায়। নতুন প্রজন্মের ব্যান্ডগুলোর প্রতি অবমূল্যায়ন দেখাতেও ছাড়েন না কেউ কেউ। বিভিন্ন সময় নিউ ট্যালেন্ট সার্চের মঞ্চে পারফর্মারদের সঙ্গে বিচারকের আসনে থাকা ব্যান্ড তারকাদের দুর্ব্যবহারও টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন সবসময়ই নিরহংকারী। সত্যিকার গুণিজন হলে যেমনটা হয় আর কি!

নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে সবসময় তার ব্যবহার ছিল অমায়িক। তরুণ প্রজন্মকে সবসময় তিনি মিউজিকের ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। মারা যাবার আগে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি মিউজিক ক্যাফে করার স্বপ্ন ছিল তার। তবে সে স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত অপূর্ণই থেকে গেছে।

ব্যক্তিজীবনে এত ভালো মানুষ ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু! স্যালুট না জানিয়ে পারবেন না

ভক্তের পোস্টে আইয়ুব বাচ্চুর রিপ্লাই

২০১৩ সালের মার্চ মাসের দিকে একবার অসুস্থ হন আইয়ুব বাচ্চু। অশোক নাথ নামে চট্টগ্রামের এক ভক্ত এবি’র টাইমলাইনে লিখেছিলেন, “বাচ্চু ভাই, আমি আমার জীবনের চাইতে আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আপনি আমার প্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে একজন। বস, আমি আপনাকে হারাতে চাই না। তাই শরীরের দিকে যত্ন নিবেন…”। ভক্তের প্রত্যুত্তরে এবি রিপ্লাই দেন, “ডিয়ার অশোক, আই আম টাচড… থ্যাংক ইউ…”।

আসলে আইয়ুব বাচ্চু মনে করতেন, শ্রোতারা ছাড়া তার কোনও মূল্য নেই। তাই শ্রোতাদের সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন তিনি। যেখানেই ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরতো, কিছুতেই বিরক্ত হতেন না। যতই তাড়া বা ব্যস্ততা থাকুক, তাদের সাথে সেলফি তুলতে আপত্তি করতেন না কখনো। দেশের বেশ কিছু জেলায় তার ফ্যান ক্লাব ছিল। তারা নিজ উদ্যোগে তার জন্মদিন উদযাপন করতেন। বাচ্চু তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলতেন না।

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় আইয়ুব বাচ্চুর সেই বিখ্যাত গান ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’। তুমুল শ্রোতাপ্রিয় গানটি লিখেছেন জনপ্রিয় গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলী। তবে আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে নয়, শিশুশিল্পী রাফসান কণ্ঠের মুগ্ধতা ছড়িয়ে রীতিমতো বিস্ময় বালকে পরিণত হয় সেসময়।

ব্যক্তিজীবনে এত ভালো মানুষ ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু! স্যালুট না জানিয়ে পারবেন না

ক্ষুদে শিল্পী রাফসানের সাথে আইয়ুব বাচ্চু

সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ তাকে ‘জুনিয়র আইয়ুব বাচ্চু’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন সেসময়ে। ‘জুনিয়র আইয়ুব বাচ্চু’ উপাধি পাওয়া মফস্বলের সেই রাফসানুল ইসলামকে ঢাকায় ডেকেও এনেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। অনেক আদর যত্ন করে যাবার সময় উপহার দিয়েছিলেন এলআরবি’র টি-শার্ট। সেসময় থেকে আইয়ুব বাচ্চুকে মামা বলে ডাকে এই শিশুশিল্পী রাফসান।

বাচ্চুর মৃত্যুর খবরে মুঠোফোনে বিএনসিসি’র ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে রাফসান প্রতিক্রিয়া জানায়, “আমি মামার সাথে কাটানো সময়গুলো জীবনে কোনদিন ভুলতে পারবোনা। আমি আর বেশি কিছু বলতে পারছিনা। আপনারা সবাই মামার জন্য দোয়া করবেন।”

দেশপ্রেমিক আইয়ুব বাচ্চুর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অগাথ শ্রদ্ধা। জাতীয় দিবসগুলোর কনসার্টে ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানটি গাইতে শোনা যেত তাকে। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃৎ মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের শেষ দিনগুলোতে ছায়ার মতো পাশে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। দুজনে একসাথে স্টেজ শো-ও করেছেন।

স্বাধীনতা দিবসের একটি কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি আইয়ুব বাচ্চুকে বেশ আহত করত। ২০১৩-১৪ সালে দেশে হঠাৎ করে ইসলাম অবমাননা বেড়ে গেলে তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে ‘বুকের ভেতর আছে আল্লাহ’, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ গানগুলো করতেন। এর আগেও তিনি ‘একচালা টিনের ঘর’সহ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বার্তাসমৃদ্ধ গান নিয়ে হাজির হয়েছেন শ্রোতাদের মাঝে।

সব কিছুর উর্ধ্বে তার ছিল অনুকরণীয় মানবিক ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন সময় তিনি দুস্থ ও দুর্গতদের সাহায্যার্থে আয়োজিত কনসার্টে বিনা পারিশ্রমিকে গান করতেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কিংবা মাদক প্রতিরোধের জন্য আয়োজিত কনসার্টে অংশ নিয়ে ভক্তদের উদাত্ত আহ্বান জানাতেন তিনি। তারুণ্যকে হতাশার অন্ধকারে ডুবতে মানা করে শোনাতেন এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা, “বহুদূর যেতে হবে, এখনও পথের অনেক রয়েছে বাকি… তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি থেমে যেও না…”