শুক্রবার, ২৬শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ১১ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

চিৎকার বন্ধে খাসোগির মুখে কাপড় দেন মুতবের

অনলাইন ডেস্ক : সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ‘নতুন তথ্য’ দিলেন সৌদি আরবের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। সৌদি কর্তৃপক্ষের স্বীকারোক্তি দেওয়ার এক দিন পর এই নতুন তথ্য দিলেন সৌদি কর্মকর্তা। ১৫ জন সৌদি কর্মকর্তার ইস্তাম্বুল যাওয়া, খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রতিরোধের মুখে টুকরো টুকরো করার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে তথ্য দিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, কনস্যুলেটের ভেতরে জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয় এবং হত্যার পর খাসোগির পোশাক পরে এক কর্মকর্তা কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে যান। জামাল খাসোগি কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন এটা প্রমাণ করতেই এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।

সৌদি কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান মেজর জেনারেল আহমেদ আল-আসিরি ১৫ জনের দল গঠন করেন। জামাল খাসোগির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বুঝিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সরকার। এ জন্য ১৫ সদস্যের এ দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠানো হয়। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বনের স্থায়ী আদেশ জারি ছিল ১৫ সদস্যের দলের প্রত্যেক সদস্যর প্রতি। তবে অনুমতি ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল ১৫ জনের। দলটির পরিকল্পনা ছিল, ইস্তাম্বুলের বাইরে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাসোগিকে আটকে রাখার হবে। শেষ পর্যন্ত যদি রিয়াদে ফিরতে না চান তবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, ১৫ জনের দলে অনেক নির্দেশনা ছিল। কিন্তু শুরুতেই সবকিছু ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকে। একপর্যায়ে কর্মকর্তারা আদেশ লঙ্ঘন করে দ্রুত সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা খাসোগিকে কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে নেয়। যেখানে মাহের মুতরেব নামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

খাসোগি মুতরেবকে বলেন, যদি তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট ভবন থেকে বের না হন, তাহলে তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বাইরে থাকা তার বান্ধবী।

মুতরেব কূটনৈতিক নীতি-নৈতিকতা লঙ্ঘন করছেন উল্লেখ করে খাসোগি বলেন, আপনি আমার সঙ্গে কী করতে যাচ্ছেন। আপনি কী আমাকে অপহরণ করতে চান? মাহের মুতরেব বলেন, হ্যাঁ। আমরা তোমাকে ওষুধ দেব এবং এখান থেকে তুলে নিয়ে যাব। এরপর খাসোগি চিৎকার শুরু করলে তাকে শান্ত করতে মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিৎকার থামানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে মারা যান খাসোগি।

ঘটনার ১৭ দিন পর ‘হাতাহাতির একপর্যায়ে খাসোগির মৃত্যু’ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর আগপর্যন্ত ঘটনার ব্যাপারে টানা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটি।

২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনার প্রয়োজনে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌদির খ্যাতনামা সাংবাদিক খাসোগি। শুরু থেকে তুরস্ক দাবি করে আসছে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি চরেরা হত্যা করেছে। গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর রোষানলে পড়েন খাসোগি। তিনি দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ যুবরাজ মোহাম্মদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম লেখেন। অভিযোগ উঠেছে, যুবরাজের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে।

এই প্রথমবার সৌদি আরব স্বীকার করল খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রাথমিক প্রমাণের তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে হাতাহাতির একপর্যায়ে জামাল খাসোগি মারা যান। এতে বলা হয়, গোয়েন্দা উপপ্রধান আহমাদ আল-আসিরি ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জ্যেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদ আল-কাহতানিকে এ ঘটনায় বরখাস্ত করা হয়েছে।

সৌদির প্রধান আইন কর্মকর্তা শেখ সৌদ আল-মোজেব এক বিবৃতিতে খাসোগির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে খাসোগির দেহ কোথায় রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দেননি।

বিবৃতিতে বলা হয়, কনস্যুলেট ভবনের ভেতর যে লোকগুলোর সঙ্গে খাসোগির দেখা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে তাঁর মারামারি হয়। একপর্যায়ে খাসোগি মারা যান। বিবৃতিতে খাসোগির আত্মার শান্তি কামনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

বরখাস্ত হওয়া সৌদ আল-কাহতানি ছিলেন সৌদি রাজ কোর্টের প্রভাবশালী সদস্য এবং যুবরাজ মোহাম্মদের উপদেষ্টা। টুইটারে তাঁর ১০ লাখেরও বেশি অনুসারী রয়েছে।

সৌদি আরবের হঠাৎ এই সুর পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, এত দিন অস্বীকৃতি জানানোর পর সৌদি আরব স্বীকার করছে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। তবে তুর্কি সরকারের তদন্তের সঙ্গে এর বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। তুর্কি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে খাসোগিকে নির্যাতন, হত্যা ও হত্যার পর করাত দিয়ে দেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। ১৭ দিন পর সৌদি সংস্করণ আনা হয়েছে সেই ঘটনায়। দাবি করা হচ্ছে, মারামারির ঘটনা থেকে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। সৌদির দাবি, এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। সৌদির এ ব্যাখ্যা ‘তালগোল পাকানো নাটকের’ মতো লাগছে।

সৌদি আরবের এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, যা ঘটেছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ কিন্তু সৌদি আরব তাঁদের ‘বড় মিত্র’।

এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, এই গ্রেপ্তারকে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রথম পদক্ষেপ’ বলা যায়। এত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনায় তিনি সৌদির প্রশংসা করেন। সৌদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মার্কিন অর্থনীতিতে সম্ভাব্য কী প্রভাব পড়তে পারত, সে ব্যাপারে কথা বলেন তিনি।

সৌদি ঘোষণার পরপরই হোয়াইট হাউস এক বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, খাসোগির মৃত্যুর নিশ্চিত খবর পাওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ‘গভীরভাবে মর্মাহত’। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কাছ থেকে জানতে পেরেছে যে জামাল খাসোগির ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে দেশটির তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এই দুঃখজনক ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের বিষয় আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং আনুষঙ্গিক কাজসহ যথাসময়ে স্বচ্ছ ন্যায়বিচারের পরামর্শ দিচ্ছি। খাসোগির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত এবং তাঁর পরিবার, প্রেমিকা ও বন্ধুদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’

গোয়েন্দা বিভাগের পুনর্গঠনে সৌদি বাদশাহ সালমান যুবরাজ মোহাম্মদের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে খাসোগির ঘটনায় সৌদি বাদশাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স ও সিএনএন