শুক্রবার, ২৬শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ১১ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

তিনি কথা নিলেন যেন কাউকে না জানাই…

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতপ্রেমী মানুষগুলো হয়ত এই তারিখটা ভুলবেন না। কারণ এই দিনে রুপালী গিটার ছেড়ে বহুদূরে চলে গেছেন কিংবদন্তি ব্যান্ড সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু।তিনি বেঁচে থাকতে তার গুণাবলীগুলো হয়তো সবার মুখে মুখে শব্দ হয়ে বের হয়নি। কিন্তু মানুষটা চলে যাওয়ার পর বিশিষ্টজনরা জানান দিচ্ছেন ৫৬ বছর বয়সী মানুষটা কী ছিলেন, কী করেছিলেন।

আজ আমাদের সময়ের অনলাইন পাঠকদের জন্য একটি অজানা ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে যা আইয়ুব বাচ্চু তার জীবদ্দশায় কাউকে বলতে চাননি।নেত্রকোনার কৃষ্ণপুর বড়বাড়ির অধিবাসী আবু বকর আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর (২১ অক্টোবর ২০১৮) সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন-২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আমার আড়াই বছর বয়সী ভাগিনা আয়ানকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে জরুরি ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করানোর প্রয়োজন দেখা দেয়।

অপারেশনটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। আয়ানকে বাঁচাতে হলে এই অপারেশনের কোনো বিকল্প ছিল না। বিভিন্ন সোর্স থেকে অপারেশনের জন্য টাকা সংগ্রহ করার পরও প্রায় দেড় লাখ টাকার ঘাটতি ছিল, যা কোনোভাবেই এই অল্প সময়ের মধ্যে জোগাড় করতে পারছিলাম না।তখন আর উপায়ন্তর না দেখে রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ফেসবুকে আয়ানের অপারেশনের জন্য সাহায্য চেয়ে একটি পোস্ট দেই। সময় হাতে ছিল আরও সাত ঘণ্টা।

কিন্তু সকাল ৯টা পর্যন্ত কারো কোনো সাহায্য না পেয়ে হতাশ হয়ে গেলাম। ডাক্তার সাহেবকে অনুরোধ করলাম অপারেশন শুরু করার প্রস্তুতি নিতে এবং সংগৃহীত টাকা পেমেন্ট করে বকেয়া টাকার জন্য তিন ঘণ্টা সময় নিলাম।অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক তখনই এক মহান ব্যক্তির আগমন ঘটল সেখানে। এসেই তিনি আয়ানের অভিভাবককে খুঁজতে লাগলেন। আমরা তখন তার সঙ্গে কথা বললাম এবং খুবই অবাক হলাম ওনাকে দেখে। জানতে পারলাম উনি ফেসবুকের পোস্টটা দেখে আয়ানকে দেখতে এসেছেন। জরুরি বিভাগ থেকে আয়ানকে অচেতন এবং অক্সিজেন মাস্ক পরানো অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারের সামনে আনা হয়।

ওই ভদ্রলোক আয়ানকে দেখে কাছে গেলেন এবং আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দুই-তিনবার বললেন, আয়ান বাবুটা, সোনামনিটা, আল্লাহ তোমাকে ভালো করে দিবেন, সুস্থ করে দিবেন।কথাগুলো বলে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। তার কান্না দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম। যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়ানকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো। প্রায় চার ঘণ্টা লাগল অপারেশন শেষ হতে।

আল্লাহর অশেষ রহমতে অপারেশন সফল হলো। পরে টাকা জমা দিতে গিয়ে জানতে পারলাম বকেয়া টাকা পরিশোধ হয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুজি করে জানতে পারলাম টাকা দিয়েছেন মহান সেই ব্যক্তিটি, যার নাম আইয়ুব বাচ্চু।পরে তার কাছে গেলাম। হাত মেলালাম, বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনিও তাই করলেন। বকেয়া টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন জানিয়ে আমার কাছে থেকে তিনি কথা নিলেন যেন কথাটা কাউকে না জানাই। আর যদি জানাতেই হয় তাহলে যেন তার মৃত্যুর পর জানাই। তিনি বেঁচে থাকতে নয়।

আজ তিনি জীবিত নেই। তাই নিজেকে কোনোভাবেই আর আটকাতে পারলাম না, বলে ফেললাম। ইনি আর কেউ নন, প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু। মহান আল্লাহতায়ালা এই মহামানবকে বেহেশত নসিব করুক… আমিন, আমিন, আমিন।’একজন অচেনা মানুয়ের আহ্বানে ছুঁটে গিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। হতে পারে এমন আরও অনেককে চুপিসারে সাহায্য করেছেন আপন ভেবে, মানুষকে ভালোবেসে। আইয়ুব বাচ্চু আর ফিরবেন না। কিন্তু মানুষ মনে রাখবে তাকে, তার এই গুণাবলীকে।