শনিবার, ২৭শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ১২ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

সুন্দরবনে বাঘঅস্তিত্ব সংকটে : খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে আসছে

সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট  : সুন্দরবনের বাঘঅস্তিত্ব সংকটেখাদ্যের অভাবে সুন্দরবনের বাঘ এখনও লোকালয়ে চলে আসছে। লোকালয়ে এলে এসব বাঘ মানুষসহ হামলে পড়ছে গবাদি পশুর ওপর। প্রায়ই এসব ঘটনা ঘটায় আতঙ্ক বাড়ছে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের মানুষদের মধ্যে।

আজ রোববার বিশ্ব বাঘ দিবস। বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও রাশিয়ায় বাঘ রয়েছে বিশ্বের এমন ১৩টি দেশে এ দিনটি পালিত হবে। বিশ্ব বাঘ দিবস উপলক্ষে এবারও সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটে নানা কর্মসুচীর আয়োজন করা হয়েছে।

আজ রবিবার সকালে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলা উপজেলায় বাঘ দিবেসের র‌্যালী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ দিবসে উপজেলা প্রশাসন ও সুন্দরবন বন বিভাগের কর্মকর্তা ছাড়াও জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ মাহমুদুল হাসান  বলেন বিশ^ বাঘ দিবসটি বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। গত বছর বাঘ দিবসের জাতীয় অনুষ্ঠান হয়েছিল বাগেরহাটে। এবার এ অনুষ্ঠান হবে খুলনাতে। এছাড়াও বন সংলগ্ন এলাকা বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলায় দিবসটি পালন করা হবে।

বিশ্বের অন্য দেশগুলো বাঘ বাঁচাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ৩৮ বছরে (জুলাই ১৯৮০ থেকে ২০১৮) সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় শিকারিদের হানা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৮৭টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। প্রজনন বৃদ্ধি ও সঠিকভাবে বাঘ সংরণের জন্য সরকারি ভাবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের এ অমূল্য সম্পদ বাঘের মৃত্যুর জন্য ৯ টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে রয়েছেÑপ্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস), লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, মিঠাপানির অভাব, খাদ্য সংকট, বন ধ্বংস, বাঘের আবাসস্থল অভাব, চোরাশিকারি ইত্যাদি।

২০০৪ সালে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা ও সাতীরা রেঞ্জ এলাকায় ৮৯টি পুরুষ ও ১৭০টি স্ত্রী বাঘ এবং ১২টি বাচ্চা বাঘ রয়েছে। এ ছাড়া বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় ৩২টি পুরুষ ও ১২৮টি স্ত্রী বাঘ এবং ৯টি বাচ্চা বাঘের অবস্থান জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে গণনায় বাঘের সংখ্যা ১০৬ টিতে দাড়িয়েছে। নতুন করে এবারও বাঘ গননার কাজ চলছে।খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে মানুষের অবাধ বিচারন, বন উজাড়, বাঘের আবাসস্থল সংকটসহ নানা কারনে বাঘের প্রজনন প্রকৃতিক পরিবেশ হারাচ্ছে। বাঘের স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এসব কারনে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে।

তিনি আরও বলেন, বাঘ রক্ষা ও বংশ বৃদ্ধি করতে হলে ‘বাঘ বনের যেখানে থাকতে পছন্দ করে সেখানে বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। কয়েকটি এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষনা করতে হবে। সঠিক ভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজণীয় লজিষ্টিক সার্পোট থাকতে হবে। এছাড়া মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাহলে বাঘের বংশ বৃদ্ধি সম্ভব বলে তিনি দাবী করেন। অতীতে বাঘ গণনায় নানা গোজামিল ছিল তিনি উল্লেখ করেন।

সুন্দরবনের বন্যপ্রানী ও জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’ চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম  বলেন, সুন্দরবনে আশঙ্কাজনক হারে বাঘ শিকার বাড়ছে বলে জানালেও বন বিভাগ তাতে গুরুত্ব দেয়নি। সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে আসার প্রমান মিলেছে। বাংলাদেশের ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনই বাঘের প্রধান আশ্রয়স্থল। সুন্দরবনে বর্তমানে উজানে মিটা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবনের পরিমান বেড়েই চলেছে। মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেল ছাড়াও সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে বর্তমানে ভারতে বাগেরহাটের পর্ব সুন্দরবনের শ্যালা ও সাতক্ষীরার পশ্চিম সুন্দরবনের আন্টিহারা দিয়ে দু’টি নৌপ্রটোকল রুট চালু থাকায় এই ম্যানগ্রোভ বনটি কার্যত চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। চোরা শিকারীদের তৎপরতা বৃদ্ধি, জাহাজ ও র্কাগোর হর্ণসহ ভেসেলগুলোর বিকট শব্দ, একের পর এক র্কাগো ডুবিতে সুন্দরবন দূষন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, আশঙ্কাজনক হারে মানুষের উপস্থিতি, লবন পানির আধিক্য, বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় কারনে এই করুন অবস্থা সুন্দরবনের প্রকৃত পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।

তিনি আরও বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। আবার সুপার সাইকোন সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভেতর প্রবেশ করে আর বের হতে পারছে না। এতে বনের মিষ্টিপানির পুকুরগুলো লোনা পানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টি পানির আশায় লোকালয়ে প্রবেশ করছে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সুন্দরবনে ৫৩টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজন ২৫টি বাঘ পিটিয়ে এবং চোরা শিকারিরা ১৭টি বাঘ কৌশলে হত্যা করে। ১১টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। বন বিভাগের রেকর্ডের বাইরেও বাঘসহ বন্যপ্রাণী মারা পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মারা যাওয়া বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কৌশলে ওই আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। চীন, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাজার রয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের সহযোগিতায় দেশীয় পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। ওই চক্র কৌশলে সুন্দরবনে বাঘসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হত্যা করছে।পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডি এফ ও) মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে বাঘ জরিপ শুরু হয়ে ১২ মে শেষ হয়েছে। এখন ডাটা অ্যানালাইসিস করে রিপোর্ট দিলে সুন্দরবনে প্রকৃত বাঘের সংখ্যা কত তা জানা যাবে’।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখনই খবর পাই কোনো বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে তখনই বাঘটিকে নিরাপদে বনে ফিরে যেতে সহায়তা করতে ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ েেত্র তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই বাঘকে হত্যা করা হয়। কারণ, স্থানীয় মানুষ সব সময় নিজেদের প্রাণ রার প্রস্তুতি রাখে। তিনি সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণসহ মূল্যবান প্রাণী রায় বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল ও উপকরণ সরবরাহের জন্য সকারের প্রতি দাবি জানান তিনি’।

সুন্দরবন বিভাগের লোকবল ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সংকটের কারণে বাঘ সংরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিনিয়িত বাঘের মৃত্যু ঘটছে। ফলে সুন্দরবনে বাঘের স্বাভাবিক বংশ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। বনবিভাগের জনবল ও প্রয়োজনীয় জলযান এবং লোকালয়ে প্রবেশকৃত বাঘকে বনে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ট্রাঙ্কুলাইজারসহ পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় তারাও সুন্দরবনের বাঘকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ফলে সুন্দরবনের বাঘ চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় প্রজনন বৃদ্ধি ও সঠিকভাবে বাঘ সংরণের জন্য সরকারিভাবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরণ ইউনিয়ন, আইইউসিএন-এর লাল তালিকা অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ২৫০০। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ২০০টি। কিন্তু ২০০৪-এ বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি ।ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের টিম লিডার আলমগীর জানান বাঘ লোকালয়ে আসলে আমরা তাকে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বনে ফিরিয়ে দেই। এ পর্যন্ত বহু বন্যপ্রাণী বনে ফিরিয়ে দিয়েছি এটা আমাদের জন্য গর্বের এবং গৌরবের।