শনিবার, ২৭শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ১২ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

‘মুসলিম সিসিলি’ — ইতালিতে ইসলামের উত্থান এবং পতন

ইউরোপ মহাদেশের ইসলামের ব্যাপারে কথা উঠলেই উৎসাহ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বারবার আল-আন্দালুস (মুসলিম স্পেন) এবং ওসমানী খিলাফতের দিকেই চলে যায়। আল-আন্দালুস এর সময়কাল ছিল ৭১১ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (তবে ১৪৯২-র পরে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হিসেবে ছিল ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)। অন্যদিকে আনাতোলিয়া থেকে ওসমানীরা ১৪শ শতাব্দী হতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ শাসন করে।

তবে ইতালির দক্ষিণ উপকূলে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জে মুসলিম শাসনামলটি মানুষের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। দ্বীপটিতে ছিল এক বৃহদাকার মুসলিম জনসংখ্যার আবাস এবং এখানে মুসলিমরা ২০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে শাসনকার্য পরিচালনা করে। এই আর্টিকেলে আমরা অনুসন্ধান করব কিভাবে সিসিলিতে আগলাবি রাজবংশের অধীনে ইসলামের উত্থান হয়, দ্বীপটিতে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়, এবং সর্বশেষ ১১শ শতকে কিভাবে দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ নরম্যানদের অধীনে চলে যায়। এই আর্টিকেলের দ্বিতীয় পর্বে মুসলিম সিসিলির সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস পর্যালোচনা করা হবে।

উত্তর আফ্রিকার আগলাবি শাসন
মুসলিমদের উত্তর আফ্রিকা বিজয়কে মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক যুদ্ধ হিসেবে দেখা যায়, যার সূচনা হয়েছিল রাসূল ﷺ এর সময়কালেই। খলিফা উমর (রাঃ) এর শাসনামলে (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) খিলাফতের রাজনৈতিক সীমানা বিস্তারের এক বিস্ফোরণ ঘটে বলা চলে। সে সময়েই মুসলিমরা উত্তর আফ্রিকার মিশর থেকে লিবিয়ার পূর্বাংশ পর্যন্ত জয় করে নেয়। মুসলিমদের সামরিক অভিযান কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে খলিফা উসমান (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) এর সময়কালে। তবে তা পুনরায় শুরু হয় মুয়াবিয়া (রাঃ) দ্বারা ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর। ৭ম শতাব্দীর শেষভাগেই মুসা ইবন নুসাইর এর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী মরক্কোতে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে পৌঁছে যায়।
aghlabid

৯ম-১০ম শতকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্র, কেন্দ্রে আগলাবি সাম্রাজ্য

উত্তর আফ্রিকাতে উমাইয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল খুবই দুর্বল এবং ভঙ্গুর। উপকূলবর্তী গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো উমাইয়াদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পল্লী অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় অধিবাসী ‘আমাজিগ’-দের আধিপত্য ছিল। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় বিপ্লবের পর নতুন এক পরিবারের হাতে খিলাফত হস্তান্তর হয় এবং মুসলিম বিশ্বের জন্য নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় বাগদাদে। এর ফলে উত্তর আফ্রিকার স্বায়ত্তশাসন অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পায়।

রাজধানী বাগদাদ থেকে বহুদূরবর্তী অঞ্চল উত্তর আফ্রিকায় শাসনকার্য পরিচালনার জটিলতার কথা চিন্তা করে আব্বাসীয় সরকার ভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তারা ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে কায়রাওয়ান নগরীতে (বর্তমান তিউনিশিয়ার একটি শহর) ‘ইব্রাহিম ইবন আল-আগলাব’ নামক একজন স্থানীয় গভর্নরকে একটি অর্ধ-স্বায়ত্তশাসিত রাজবংশ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয় এবং তাকে শাসনকার্য পরিচালনার ভার দেয়। যদিও আগলাবিরা নামেমাত্র আব্বাসীয়দের আধিপত্য মেনে নিয়েছিল। ইতিপূর্বে উমাইয়াদের নীতি রাজনৈতিক সীমানা বৃদ্ধির দিকে থাকলেও, আব্বাসীয় যুগে এসে এর পরিবর্তন ঘটে। শুরুর দিকে আগলাবি আমিরাত নজর দেয় অভ্যন্তরীণ দলাদলি নিয়ন্ত্রণে আনার দিকে। বিশেষ করে আরব-প্রভাবিত সেনাবাহিনীর সাথে আমাজিগদের দ্বন্দ্ব ছিল একটি বড় সমস্যা।

সিসিলি বিজয়
৯ম শতকের শুরুর দিকে সৃষ্ট অচলবাস্থা কিছু ঘটনার জন্ম দেয় যার ফলে আগলাবিরা সিসিলিতে অভিযান পরিচালনা করে। প্রথমত, সিসিলি দ্বীপপুঞ্জে কিছু রাজনৈতিক সমস্যার কারণে এক বাইজেন্টাইন নৌবাহিনী কমান্ডার ‘ইউফেমিয়াস’ নিজ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং ৮২৬ খ্রিস্টাব্দে আগলাবি আদালতে গিয়ে উপস্থিত হয়। তার বিদ্রোহের কারণ কি ছিল তা জানা যায়না। অন্যদিকে ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনদের সাথে স্বাক্ষরিত এক শান্তিচুক্তি — যা আপাতদৃষ্টিতে তখনও বহাল ছিল — এর কারণে আগলাবি আমির ‘প্রথম জিয়াদাতাল্লাহ’ শুরুতে ইউফেমিয়াসকে সাহায্য করতে ইতস্তত বোধ করেন।

এ ঘটনায় আরেকজন গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যা সিসিলি আক্রমণকে বাস্তব রূপ দেয়। আগলাবি আমিরাতে তখন আসাদ ইবন আল-ফুরাত নামক একজন ফিক্‌হ (ইসলামী আইন) এর স্কলার ছিলেন, যিনি প্রাচ্য থেকে পড়ালেখা করে এসেছিলেন। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ইমাম মালিক (রহঃ) এবং আবু হানিফা (রহঃ)-এর দুইজন ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ আল-শায়বানি। ইবন আল-ফুরাত আগলাবি আমিরাতে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। আর তৎকালীন সময়ের সেরা কয়েকজন স্কলারের সাথে পড়ালেখা করার সুবাদে তিনি সর্বসাধারণেরও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাই তিনি ছিলেন আমির জিয়াদাতাল্লাহর কাছে এক ধরণের আপদ এর শামিল যিনি সমস্যার সৃষ্টি করে আমিরাতকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তবে ইবন আল-ফুরাতও সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণের পক্ষেই ছিলেন যা আমিরের কপালের চিন্তার ভাঁজ দূর করে দেয়। তিনি যুক্তি দেখান যে, বাইজেন্টাইনরা বেশকিছু মুসলিম ব্যবসায়ীকে অপহরণ করায় বাইজেন্টাইনদের সাথে সাক্ষরিত চুক্তিটি ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে গিয়েছে।

পরিস্থিতি আমির জিয়াদাতাল্লাহর একদম অনুকূলে চলে আসে। তিনি ভেবেছিলেন সিসিলি আক্রমণের মাধ্যমে তিনি বাইজেন্টাইনদের আক্রমণ করে ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রে তাদের বাণিজ্যিক উপস্থিতি দুর্বল করে দিতে পারবেন। একইসাথে সিসিলি আক্রমণও যেহেতু সফল হবার চেয়ে বরং দুর্ভাগ্যই বয়ে আনবে, সেহেতু আসাদ ইবনে আল-ফুরাতকে (বহুসংখ্যক বিদ্রোহী জনতা ও সৈন্যসহ) দ্বীপ অভিমুখে এক অসফল অভিযানে পাঠালে আমিরাতে তার নিয়ন্ত্রণও আরো দৃঢ় হবে।

কিন্তু অভিযানটি ধারণার চেয়েও বেশী সফল হয়েছিল। ১০,০০০ এরও বেশী সৈন্য নিয়ে সেনাবাহিনী ৮২৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে উত্তর আফ্রিকা ত্যাগ করে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে গিয়ে পৌঁছায়। আসাদ ইবন আল-ফুরাত এর বাহিনীর সাথে স্থানীয় বাইজেন্টাইন বাহিনীরর যুদ্ধ মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়। আর বেশীরভাগ বাইজেন্টাইন সৈন্যই পিছু হটে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের উত্তর ও পূর্ব উপকূলের দুর্গবেষ্টিত শহর — যথাক্রমে পালেরমো এবং সাইরাকুস — এ আশ্রয় নেয়।

মুসলিম বাহিনীও উপকূল থেকে ভেতরে প্রবেশ করে এবং পালেরমো অবরোধ করতে যায়। তবে বাইজেন্টাইনরা নতুন সৈন্যবাহিনী এবং এজিয়ান সাগর থেকে জাহাজ এনে শক্তিবৃদ্ধি করে মুসলিমদের পিছু পিছু আসে। ফলে মুসলিমদের পালেরমো অবরোধ ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে মুসলিমদের মাঝে প্লেগে রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে আসাদ ইবন আল-ফুরাত প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি আর প্লেগ রোগের কারণে অনেক সৈন্যের মৃত্যুর ফলে মনে হচ্ছিল মুসলিম বাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তখনই ঘটনাক্রমে আল-আন্দালুস (মুসলিম স্পেন) থেকে একদল মুসলিম বাহিনী আসে এবং ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আগলাবি বাহিনীর অবশিষ্টাংশের সাথে যোগ দেয়। ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টোদিকে মোড় নেয়। পুনরুজ্জীবিত মুসলিম বাহিনী পালেরমোতে দুর্বার গতিতে প্রবেশ করে এবং সফলভাবে অবরোধ করে ও জয়লাভ করে।

এসময় জিয়াদাতাল্লাহ প্রকৃতই সিসিলির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন, যদিও তিনি নিজে সরাসরি সিসিলি অভিযানে খুব একটা জড়িত ছিলেননা। নিজ চাচাত ভাইকে পালেরমোর গভর্নর হিসেবে পাঠানোর মাধ্যমে সিসিলিকে তিনি আগলাবি আমিরাতের একটি প্রদেশ হিসেবে পরিচালিত করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠা করা হয় সিসিলির সরকার এবং অর্থনীতি। ধীরে ধীরে সমগ্র দ্বীপপুঞ্জটির উপর আগলাবিদের আগ্রহ নতুন করে জন্মাতে শুরু করে। আর ছোট ছোট খণ্ডে খণ্ডে দ্বীপপুঞ্জটি মুসলিমরা জয় করতে থাকে। পালেরমোর বাইরের শহর এবং গ্রামগুলো মুসলিম নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। আর দ্বীপপুঞ্জের পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে লম্বা সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। শেষ পর্যন্ত সাইরাকুস ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এবং সর্বশেষ বাইজেন্টাইন অঞ্চল ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
sicily

সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ

সিসিলিতে সরকারী শাসনব্যবস্থা আগলাবি আমিরাতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই নির্ধারণ করা হয়। প্রদেশটি একটি গভর্নর দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে যিনি নামেমাত্র কায়রাওয়ানের আগলাবি আমিরের অধীনস্ত ছিলেন, কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মোটামুটি স্বাধীনভাবেই শাসন করতেন)। মুসলিমরা কাজী এবং স্কলারদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী আইন অনুসরণ করতেন। আর খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা জিযিয়া বা poll tax (মাথাপিছু ধার্যকৃত কর) এবং ভূমিকর দেয়ার শর্তে নিজেদের ধর্মীয় আইন অনুসরণ করার স্বাধীনতা পায়। অন্যদিকে মুসলিমদের দিতে হতো যাকাত এবং ভূমিকর।

সিসিলিতে ফাতেমীয় শাসন
১০ম শতকের শুরুর দিকে উত্তর আফ্রিকায় এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের উত্থান হয় যার প্রভাব পড়ে গোটা মুসলিম বিশ্বের উপর। ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে, নিজেকে রাসূল ﷺ এর বংশধর দাবী করা আব্দুল্লাহ আল-মাহদি নামক এক ব্যক্তি নিজেকে ইসমাইলী শিয়া সম্প্রদায়ের ইমাম এবং মুসলিম বিশ্বের বৈধ নেতা হিসেবে দাবী করে। গোটা উত্তর আফ্রিকাজুড়ে গুপ্তচর ও ধর্মান্তরকারীদের একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার এবং আমাজিগদের উপর আরবদের অসন্তুষ্টিকে ব্যবহারের মাধ্যমে আবদুল্লাহ আল-মাহদি ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে নেয়, আর কায়রাওয়ান দখলের মাধ্যমে আগলাবি রাজবংশের পতন ঘটায়।

শুরু থেকেই সিসিলি আমিরাতের সাথে উত্তর আফ্রিকা সরকারের যোগসূত্র ছিল। শিয়ারা ক্ষমতা দখলের পর স্থানীয় নেতারা ভাবলেন শিয়াদের সাথেও হয়তো সম্পর্কটা এমন কিছুই হবে। তাই সিসিলির অভিজাত শ্রেণী তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ফাতিমীদ শিয়াদের সাথে দেখা করে নিজেদের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তা না করে শিয়ারা উত্তর আফ্রিকায় তাদের জেলে বন্দী করে। এর বদলে আল-মাহদী সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ শাসনের জন্য ইমামের নামে শিয়া গভর্নর এবং কাজী পাঠায়।

বিদ্রোহী আচরণ ও মনোভাবের জন্য খ্যাত সিসিলির জনসাধারণকে দমিয়ে রাখার জন্য নতুন ফাতেমীয় সরকার বেশকিছু কঠোর নীতিমালা ও আইন জারী করে। জনগণের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে সরকার ‘খুম্‌স’ নামক এক ধরনের নতুন কর জারী করে যার ফরমান হলো আয়ের ১/৫ অংশ সরাসরি ফাতেমীয় ইমামের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। এর ফলে সুন্নি জনসাধারণের সাথে সরকারের বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ফলাফলস্বরূপ সাথে সাথেই প্রথম ফাতেমীয় গভর্নরের পতন হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়।

এর পরপরই ৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নতুন আরেক বিদ্রোহ গোটা দ্বীপপুঞ্জে ফাতেমীয় প্রভাব কয়েক বছরের জন্য খর্ব করে দেয়। তবে ৯১৮ তে ফাতেমীয়রা নির্মমভাবে তা দমন করে। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে আগ্‌রিজেন্তো শহরে আরো একটি বিদ্রোহের উত্থান হয়। পুরো দ্বীপপুঞ্জের জনসাধারণ এই বিদ্রোহের সমর্থন দেয়া শুরু করে ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। আবারো এক ফাতেমীয় অভিযানের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করা হয়, গণহত্যা চালানো হয় বিভিন্ন শহরে। এতে শহরগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। শহরগুলো পুনরায় জনপূর্ণ করতে ফাতেমীয়রা উত্তর আফ্রিকা থেকে ফাতেমীয় সরকারের অনুগত নতুন অভিবাসীদের নিয়ে আসে।

দ্বীপপুঞ্জে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমীয়রা আল-হাসান আল-কাল্‌বী নামক ফাতেমীয় ইমামের অনুগত এক সামরিক ব্যক্তিকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। তার মাধ্যমে দ্বীপপুঞ্জে নতুন এক রাজবংশের অভিষেক ঘটে যার বংশধরেরা ফাতেমীয়দের অনুগত থেকে পরবর্তী শত বছর শাসনকার্য চালায়।

সিসিলিতে কাল্‌বী শাসনামলের সময় মুসলিমরা সর্বশেষ খ্রিস্টান অঞ্চল জয় করলেও দ্বীপপুঞ্জে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ থামেনি। সুন্নিদের উপর ফাতেমীয়দের নির্যাতন দ্বীপপুঞ্জের বেশীরভাগ মানুষ সহ্য করে গেলেও, স্থানীয় মুসলিম, উত্তর আফ্রিকার আরব এবং আমাজিগ অভিবাসীদের মধ্যে অব্যহত উত্তেজনার ফলে সামাজিক বিভাজন বড় আকার ধারণ করে।

সামরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মধ্য ভূমধ্যসাগরে সিসিলির পতন শুরু হয় কাল্‌বী শাসনামল থেকে। ১১শ শতকের শুরুর দিকে ইতালিয় উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের বাইজেন্টাইন চৌকিগুলোতে সামরিক অভিযান চালানোর ঝোঁক আর কাল্‌বী আমীরগণদের মাঝে ছিলনা। জনসাধারণও অলস হয়ে পড়ে, আর বেশীরভাগ পুরুষই সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান থেকে নিষ্কৃতি পেতে দেন-দরবার শুরু করে।

নরম্যানদের সিসিলি জয় এবং মুসলিম সিসিলির পতন
৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমীয়দের মিশর বিজয়ের পর থেকেই উত্তর আফ্রিকার বেশীরভাগ সামরিক এবং নৌশক্তি পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে স্থানান্তরিত হয়। এর ফলে সিসিলির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে এবং বাইজেন্টাইনদের আক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাই সিসিলিকে নিজস্ব প্রতিরক্ষায় সক্ষম এমন এক স্বাধীন ও সুসংগঠিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে ১১শ শতকের শুরুর দিকে কাল্‌বী আমীর আল-আক্‌হাল সিসিলির মুসলিমদের উপর নতুন কর আরোপ করেন।
italy

১০০০ খ্রিস্টাব্দে ইতালি

এমনিতেই সিসিলির জনসাধারণের সাথে ফাতেমীয় ও কাল্‌বী নেতাদের মাঝে আগে থেকেই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সাথে নতুন কর আরোপের বিষয়টি যুক্ত হয়ে ব্যাপারটা (পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে) আরো জটিল হয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে সিসিলির গণ্যমান্য কিছু ব্যক্তিবর্গ তিউনিসিয়াতে সবেমাত্র স্বাধীনতা লাভ করা জিরুন সাম্রাজ্যের কাছে সাহায্যের জন্য যায়। ১০৩৬ খ্রিস্টাব্দে জিরুন বাহিনী উত্তর আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সিসিলি আসে, দ্রুত পালেরমো জয় করে নেয় এবং আমীর আল-আক্‌হালকে হত্যা করে।

জিরুনরা সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে চেয়েছিল, অনেকটা দুই শতাব্দী পূর্বে আগলাবিদের মতো। কিন্তু উত্তর আফ্রিকার আধিপত্যের কথা চিন্তা করে পালেরমোর জনসাধারণ নতুন জিরুন গভর্নরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং সিসিলিতে পৌঁছানোর অল্প সময়ের মধ্যেই জিরুনদেরকে তিউনিসিয়া ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়।

এসময় সিসিলির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আর কারো হাতে ছিলনা এবং সিসিলি অকেন্দ্রীভূত এক অচলাবস্থা পার করতে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন প্রদেশের সামরিক নেতৃবর্গ তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অবস্থাটা অনেকটা আল-আন্দালুসের তাইফা যুগের মতো হয়ে যায়। জাতিগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-রেষারেষি অঞ্চলটির মুসলিমদের বিভক্ত করে এবং একে অপরের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বহুদলে পরিণত করে।

আল-আন্দালুসের সাথে এই ঘটনার অন্য আরেকটি দিক দিয়ে মিল ছিল, আর তা হলো শক্তিশালী খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর মুসলিমদের অনৈক্যের সুযোগ নেয়া। নরম্যান, উত্তর ইউরোপের এক রাজবংশ যারা তাদের সামরিক শক্তির জন্য সুপরিচিত ছিল এবং ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড জয় করেছিল। তারা তখন দক্ষিণ ইতালি শাসন করছিল এবং মুসলিম অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে তারা ১০৫২ খ্রিস্টাব্দে সিসিলি জয় করে নেয়। সিসিলি রক্ষার্থে জিরুনদের প্রচেষ্টা কখনোই সফল হয়নি কারণ উত্তর আফ্রিকায় তারা গোত্রীয় দ্বন্দ্বে ব্যস্ত ছিল, সাথে সিসিলির মুসলিমদের উত্তর আফ্রিকানদের দ্বারা শাসিত হবার অনিচ্ছাও আরেকটা কারণ ছিল।

১০৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের বেশীরভাগ অঞ্চল নরম্যানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পালেরমো হাতছাড়া হয় ১০৭২ খ্রিস্টাব্দে, আর সাইরাক্রুস ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে (আশ্চর্যজনকভাবে একই বছর আল-আন্দালুসের টলেডো নগরী খ্রিস্টান ক্যাস্টিলো সাম্রাজ্যের হাতে চলে যায়)। সর্বশেষ, সিসিলিতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ উপকূলীয় নগরী নোটো’র পতন হয় ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে।

san-giovanni-768×514

ছবিতে সিসিলির পালেরমো শহরের সান জিওভান্নি দেইয়ি এরেমিতি চার্চ, যা মুসলিম সিসিলিতে একটি মসজিদ ছিল

আল-আন্দালুসের মতো সিসিলির মুসলিমরা খ্রিস্টানদের অধীনে বসবাস করতে থাকে। নরম্যানদের বিজয়ের সময়ও দ্বীপপুঞ্জের বেশীরভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী ছিল। মুসলিমদের সাথে আচরণ নির্ভর করতো তৎকালীন সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নরম্যান রাজার লক্ষ্য এবং মর্জির উপর। ১১৩০ থেকে ১১৫৪ পর্যন্ত রাজা ‘দ্বিতীয় রজার’ এর শাসনামল ভালই ধর্মসহিষ্ণু ছিল। এসময়ই বিখ্যাত ভৌগলিক আল-ইদ্রিসি তাঁর বিশ্ব মানচিত্রাবলী (world atlas) “নুযহাত আল-মুশতাক ফি’খতিরাক আল-আফাক” (نزهة المشتاق في اختراق الآفاق, ইংরেজীঃ the book of pleasant journeys into faraway lands, যা মূলত “Tabula Rogeriana” হিসেবে সুপরিচিত) রচনা করেন।

অবস্থা যাই হোক, নরম্যান খ্রিস্টানদের অধীনে থাকার চেয়ে হাজার হাজার মুসলিম স্বেচ্ছায় নিকটস্থ মুসলিম ভূমিতে হিজরত করে। অন্যদিকে আল-শাম অঞ্চলে চলতে থাকা ক্রুসেড এবং এর সাথে সিসিলিতে বিক্ষিপ্ত মুসলিম বিদ্রোহ গোটা ইউরোপজুড়ে মুসলিম-খ্রিস্টান সম্পর্ক পর্যায়ক্রমে অবনতির দিকে নিয়ে যায়। ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে পালেরমোর মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে ‘পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট’ সিসিলির মুসলিমদেরকে দেশের জন্য “hostile elements” (দেশবিদ্বেষী বা শত্রু) হিসেবে ঘোষণা করে। ১২শ এবং ১৩শ শতকে মুসলিমদের জোর করে নির্বাসনে পাঠানো হয়, সাথে স্বেচ্ছায় নির্বাসনও চলতে থাকে। অবশেষে ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের সর্বশেষ মুসলিমদের জোর করে সিসিলি ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই ইতি ঘটে সিসিলির ৪০০ বছরের ইসলামের।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Muslim Sicily: The Rise and Fall of Islam in Italy আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ আহমেদ রাকিব