বুধবার, ৪ঠা জানুয়ারি, ২০১৭ ইং ২১শে পৌষ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

অসীম প্রেরণার উৎস প্রতিবন্ধীরা

AmaderBrahmanbaria.COM
জানুয়ারি ২, ২০১৭

মোঃ কায়ছার আলী : বিজ্ঞানী এডিসন সাফল্য সম্পর্কে বলেন, মেধা ১ শতাংশ এবং পরিশ্রম ৯৯ শতাংশ। এই সাফল্য বা সফলতা শুধু স্বাভাবিক মহামানব বা মনীষীরাই নয় অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন বা প্রতিবন্ধীরাও এর থেকে কোন অংশে পিছিয়ে নেই। পৃথিবীর প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাকাব্য লিখেছিলেন জন্মান্ধ মহাকবি হোমার। প্রতিবন্ধী হয়েও নিজ নিজ প্রতিভার বিকাশ ঘটান বর্তমান শতাব্দীর শারীরিক প্রতিবন্ধী শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, জন্মান্ধ ফরাসি সাহিত্যিক রোদাকি, খঞ্জ লর্ড বায়রন, আধুনিক আরবী কবিতার জনক অন্ধ বাশ্‌শার বিন বোরদ, আধুনিক আরবি সাহিত্যের অন্যতম জনক অন্ধ ড. তাহা হোসাইন, আরবি ভাষার মহান কবি এবং যুক্তিবাদী দার্শনিক অন্ধ কবি আবুল আলা আল মা’আরবি, মহান সুরস্রষ্টা বধির বিটোভেন, ৪৪ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান জন মিল্টন এর ১৬ বছর পর লিখেছিলেন প্যারাডাইস লস্ট।
ফরাসি নাগরিক লুইস ব্রেইল (১৮০৯-১৮৫২) অত্যন্ত মেধাবী, প্রতিভাবান এবং অধ্যবসায়ী ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। ৩ বছর বয়সে পিতার কারখানায় খেলাধুলার সময় সুঁইজাতীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে চামড়ায় গর্ত করার সময় সংঘটিত এক মারাত্মক দূর্ঘটনায় তাঁর চোখ দুটি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হয়ে গেলেও বন্ধ হয়ে যায়নি তাঁর মেধার স্ফুরণ। চক্ষুহীন জীবনকে চক্ষুময় জীবনের মত উপভোগের উপায় খুঁজে বের করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিবেদিত হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি অন্ধদের লেখা ও পড়ার জন্য কাগজের উপর মাত্র ৬টি ডট দিয়ে যাদুকরি একটি অতি সহজ ভাষা ও পদ্ধতি (ব্রেইল ভাষা) আবিষ্কার করে পুরো পৃথিবীকে হতবাক করে দেন।
তখন থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্ধ লোকেরা ৬টি ডটের অনবদ্য যাদু দিয়ে নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে তাদের জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ বদলে দেন। পূর্বে টাইপ মেশিনে দিয়ে ব্রেইল অক্ষর লেখা হত, বর্তমানে কম্পিউটারের সাহায্যে ব্রেইল ভাষা লেখা হয়। পৃথিবীবাসী শুধু মাত্র একটি পদ্ধতি আবিষ্কারের কারণে ব্রেইলের কাছে আযুগ ঋণী হয়ে থাকতে বাধ্য। তাঁর আবিষ্কৃত ভাষার জন্য পৃথিবীবাসী (বাংলাদেশসহ) শ্রদ্ধার সাথে তাঁর জন্মদিন অর্থাৎ ৪ জানুয়ারিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস হিসেবে পালন করছে।
তাঁর আবিষ্কারের সাফল্যের প্রতি আজ বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের নতুন প্রজন্মের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য একজন প্রতিবন্ধী কিন’-আলোকিত এবং কিংবদন্তির জীবনের সোনালী উজ্জ্বল চুম্বক অংশ না লিখে পারছি না। ঊনিশ শতকে এই বাসযোগ্য গ্রহে আশ্চর্য ও রহস্যময় অনবদ্য, অসাধারণ এক নারী হেলেন কেলার। নিজের দহনের আলোতে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে পৃথিবী কাঁপানো মাহাত্ম্যের মুকুট নিয়ে দেশে দেশে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের স্মৃতিতে চিরভাস্বর করে রাখার জন্য কাজ করেছেন।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন বলেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র নেপোলিয়ন এবং হেলেন কেলার। ১ম জন গায়ের জোরে পৃথিবী জয় করতে চেয়েছিলেন, কিন’ বিফল হয়েছিলেন, ২য় জন মনের জোরে পৃথিবী জয় করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি সফল হয়েছিলেন। উত্তর আমেরিকার আলবামা রাজ্যে টাসকাম্বিয়া নামে ছোট শহরে আর্থার কেলার ও ক্যাথরিন কেলার দম্পতির ঘরে তিনি ১৮৮০ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ১৯ মাস বয়সে গুরুতর অসুস’ হয়ে পড়েন। ভাগ্যের নির্দয়, নির্মম, নিষ্ঠুর পরিহাস ধীরে ধীরে কথা বলা, শোনা এবং দেখার শক্তি চিরতরে হারিয়ে যায়। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা তাঁকে ৫ বছরে টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল পরীক্ষা করে দেখেন যে, আর কোনদিন তিনি চিরসবুজ ধরনী দেখতে, তাঁর প্রিয়তমা মাকে “মা” বলে ডাকতে এবং প্রাণ প্রিয় বাবার কথা শুনতে পাবেন না। তাঁর জীবন এখন শেষ, ঝড়ৎৎু সেখানেই শুরু। ৮ বছর বয়সে হাতে আঙ্গুলে দিয়ে দাগ কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ অর্থাৎ লেখাপড়া পুনরায় শুরু করলেন। এই সাফল্যে সবাই অবাক হয়ে যায়। শিক্ষকের মুখের কম্পন ঠোঁট ও জিহ্বার নড়াচড়া হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতেন।
১৪ বছর বয়সে আমেরিকার নিউইয়র্কের রাইট হুমার্সন নামে স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০৪ সালে তিনি র্যারডক্লিক কলেজ থেকে ই.অ ডিগ্রি লাভ করেন। ঙয! যার নাম না লিখলে হেলেনের জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে তিনি হলেন তাঁর শিক্ষিকা অ্যান স্যালিভান। তাদের দু’জনের জীবন একসূত্রে গাঁথা হয়ে এক অবিভাজ্য আত্মায় পরিণত হয়েছিল।
হেলেন নিজেই লিখেছেন “তিনি যে, বিশ্বের মানুষের সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন তাঁর সবটুকু কৃতিত্ব তাঁর পারকিন্স ইনস্টিটিউশন এর ভুবন জয়ী মহতী শিক্ষিকার জন্য। ছাত্রীর হাতের উপরে নির্দিষ্ট আঙ্গুল সঞ্চালন করে তাঁকে শিক্ষা দেন এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। হেলেন প্রশ্ন জেনে টাইপ মেশিনে টাইপ করে বা হাতের আঙ্গুলের ইশারায় উত্তর দিতেন। হেলেন ৩৬ ও ৪২ বছর বয়সে দুজনের সাথে পরিচিত হলেও পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করেননি। তাদের প্রস্তাবের উত্তরে বলতেন, “আমাদের জীবন হবে ঘনকুয়াশার মধ্যে নদীতে চলা দুটো নৌকার মত। তিনি ইংরেজি, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান ও গ্রীক ভাষা জানতেন। তিনি বই পড়েছেন অনেক জ্ঞানী লোকের চেয়েও বেশি।
তিনি নিজে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সঙ্গীত উপভোগ করতেন বাদ্যযন্ত্রের উপর হাত রেখে। হাতের ছোঁয়া দিয়ে শ্রবণের কাজ করতেন, মানুষের সঙ্গে করমর্দন করলে বলে দিতে পারতেন আগের পরিচিত কি না? সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো, দাবা খেলা, তাস খেলা এবং ঘরে বসে নকশি কাঁথা সেলাই করতে পারতেন। কম্পনের অনুভূতি থেকে বলে দিতে পারতেন ছুতোর মিস্ত্রী করাত দিয়ে কাঁটছে, না রাঁদা চালাচ্ছে, না হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ফুলের পাপড়ি স্পর্শ করে ফুলের রং বলে দিতে পারতেন। তিনি নারী ও কালো মানুষের অধিকারে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি রাজনীতি করেছেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পর্বে যোগদান করতেন।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশ তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি, নাইট উপাধি এবং ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘ আমাদের দেশে প্রতীবন্ধীদের শিক্ষা, কর্মসংস’ান ও পুনর্বাসন নিয়ে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী গতকাল ব্রেইল পদ্ধতির বই অন্ধ শিশুদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। আমাদের দেশের শতকরা দশভাগ মানুষ কোন না কোনো ভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। তাদের জাতীয় জীবনের মূল স্রোতে যুক্ত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাদের করুণা নয়, সহমর্মিতায় অভিষিক্ত করা প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষক