g সরাইলে ৩৫ অবৈধ ইটভাটা বিপর্যয়ের মুখে কৃষি,জনজীবনে দূর্ভোগ | AmaderBrahmanbaria.Com – আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সোমবার, ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ইং ১০ই আশ্বিন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

সরাইলে ৩৫ অবৈধ ইটভাটা বিপর্যয়ের মুখে কৃষি,জনজীবনে দূর্ভোগ

AmaderBrahmanbaria.COM
জানুয়ারি ২১, ২০১৭

---

মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া) থেকে : সরাইলে কৃষি জমি ধ্বংস করে ফসলি জমির পাশেই দেদার গড়ে উঠছে ইটভাটা। কোন নিয়ম নীতি নেই। উৎপাদন অনুমতি নেই। নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। অবৈধ ভাবে ব্যবহার হচ্ছে বিদ্যুৎ। পুড়ছে লাকড়ি। শ্রম আইনকে দেখাচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি। মনগড়া মত কাটছে ফসলি জমি ও সরকারি জায়গার মাটি। ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি। কিছু জায়গায় ইটভাটা গিলে খাচ্ছে নদী। এক লাইসেন্সেই চলছে ভিন্ন নামের ৪-৫টি ইটভাটা। বৈধ কাগজ না থাকলেও রয়েছেন ভাড়াটিয়া মালিক। মেয়াদ উত্তীর্ণ লাইসেন্সই চড়া দামে চলছে ক্রয়-বিক্রয়। কাগজের ইটভাটার নামের সাথে ইটের নামের মিল নেই। জনপ্রিয় ব্রিকমিল হয়ে যাচ্ছে সোনা মিয়া ব্রিকস। আবার ওই ব্রিকস মিলই কখনো হয়ে যাচ্ছে ইসলাম ব্রিকস ও রিফান ব্রিকস। আশা নামের ব্রিকসমিল হয়ে যাচ্ছে পিবিসি। ইটের গায়ের ইংরেজি অক্ষরের শব্দ বলতে গিয়ে দাঁতে ঠোঁটে কাঁপন ধরে যায় অনেক মালিকের। কিছু মালিক দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত আর বলতেই পারেননি। বেশ কিছু ভাটায় রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। ব্যবহার হচ্ছে মনগড়া অবৈধ চিমনি। উড়ছে ধূঁয়া ও বালু।

নষ্ট হচ্ছে বসত ঘরের চাল আসবাবপত্র ও কাপড় চোপড়। রোগাক্রান্ত হচ্ছে ইটভাটা সংলগ্ন বাড়ি ঘরের শিশু সহ নানা বয়সের লোকজন। এ ছাড়া ইট তৈরীর মাটির জন্য দেদার কাটছে ফসলি জমি। ফলে প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে চাষাবাদের জমি। প্রভাবশালী কিছু মালিক সরকারি খাস জায়গার মাটি নিচ্ছেন ভাটায়। মোটা অংকের টাকায় সবকিছু রফাদফা করেই এখানে চলছে ৩৫টি ইটভাটা। স্থানীয় প্রশাসন নীরব। ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। অনুসন্ধানে ও উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিস সূত্রে জানা যায়, সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ, শাহজাদাপুর, শাহবাজপুর, চুন্টা ও পানিশ্বর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে মোট ৩৮ টি ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটাই জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক হুমকি। বসতবাড়ি ঘেষা ইটভাটা গুলির নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। ইট উৎপাদনের কোন অনুমতি ও দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কোন রকমে অনিয়মিত একটি কাগজ হাতে পেলেই হল। ওই কাগজটির বলে ভিন্ন নামে চলছে একাধিক ইটভাটা। আর সরাইলের অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে উঠেছে সড়ক মহাসড়ক ও নদীর পাড়ে। ফসলি জমির মাঝখানে।

বসত বাড়ি ঘেষে। ইটভাটার মালিক ওসমান মিয়া। ১০ বছর আগে সমতা ব্রিকস নামের একটি লাইসেন্স ক্রয় করেছিলেন আবদুর রহিম নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে। ওই লাইসেন্সের বলেই তিনি একে একে সরাইল এলাকায় ৩-৪ টি ইট ভাটা চালু করে দেন। স্থায়ী হননি বেশী দিন। সরাইল-নাসিরনগর সড়কের পাশে সমতার কাগজের উপর ভর করেই ওসমান রিফান নামের একটি ভাটা চালু করেন। এক বছর পর সেই ভাটাটি ভাড়া দিয়ে দেন। চলে যান শাহজাদাপুরে। সড়কের পাশে ইসলাম নাম দিয়ে আরেকটি ব্রিকসমিল চালু করেন। গত বছর নিয়ামতপুর এলাকায় ফসলি জমির মাঝখানে মোঃ হুমায়ুন রশিদ দুলুর জনপ্রিয় নামক ইটভাটাটি ওসমান ভাড়া নেন। বৈধ সকল কাগজপত্র না থাকলেও সেখানে তিনি মনগড়া মত ইট তৈরী করছেন। কখনো সেনা মিয়া কখনো এমবিসি নামের ইট তৈরী করছেন। সেখানকার অধিকাংশ কৃষক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় নালিস সালিস করেও কোন প্রতিকার পায়নি। মলাইশ গ্রামে নদীর পাড়ের কল্যাণ ব্রিকসের ধোঁয়ায় কৃষি জমি ধংস হতে থাকলে স্থানীয় কৃষকরা প্রতিকার চেয়ে নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। দীর্ঘদিন ঘুরেও কোন সুফল পায়নি সেখানকার কৃষকরা। ওসমান মিয়া বলেন, এক লাইসেন্সে একাধিক নামে ব্রিকস মিল চালানো যায়।

অন্য গুলো হল মূল মিলের ব্রান্ড। সরাইল-অরুয়াইল সড়কের পাশে লোপাড়ায় গত ৩-৪ বছর ধরে চলছে মা বাব নামের ব্রিকস মিল। লাইসেন্স বিহীন ওই মিলটি বসত বাড়ি ও মাঠের ফসলি জমির ব্যপক ক্ষতি সাধন করছে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ভ্রাম্যমান আদালত তাদের জরিমানা করেছে। এরপরও থেমে নেই তারা। ফসলি জমি ও সরকারি জায়গার মাটি কাটছেই। সড়ক ঘেষে রেখেছে কয়লা। শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে শিশু শ্রম। তাদের আইনি সকল কিছুই পক্রিয়াধীন। কিন্তু উৎপাদন রানিং। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ইটভাটার আশপাশের বোরো ফসল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। গত মৌসুমে জমির ধান পাকা শুরু হলে কৃষকরা অধিক মাত্রায় ক্ষতির সম্মুখিন হন। গত বছর প্রায় ৫০ একর জমির বোরো ধানে চিটা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সমাবেশসহ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ হয়। পরে উপজেলা প্রশাসন ভ্রম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই ভাটার মালিককে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন। কথা ছিল ফসলি জমি থেকে এটি সরিয়ে নেওয়া হবে, কিন্তু তা হয়নি। লোপাড়া গ্রামের বাসিন্দা প্রভাষক মোজাম্মেল হক বলেন,‘ইটভাটার ধুলা আর ধোঁয়ায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মালিক পক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।’ সরাইল-নাসিরনগর সড়কের পাশে ধর্মতীর্থ গ্রামের জন বসতি সংলগ্ন স্থানে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে সফল ব্রিকস নামের ইটভাটা। সম্প্রতি ওই ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমান আদালত ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। পিডিবি’র লোকজন সেইদিন ওই মিলের বিদ্যুতের সার্ভিস তারটি খুলে অফিসে নিয়ে এসেছিল। বিশেষ তদবিরে ওই সংযোগটি আবার দিয়ে দেয়া হয়। ওই সড়কের পাশেই সরকারি খাল দখল করে নদীর পাড়ে ও ফসলি জমিতে কোন বৈধ কাগজ পত্র ছাড়াই গত ২ বছর ধরে আশা নামের ইটভাটা চালিয়ে আসছেন জাকির মিয়া।

পাশেই চলছে পিবিসি নামের ব্রিকস মিল। এই মিলের প্রকৃত মালিক ছিলেন সুহিলপুরের মোঃ হোসেন ভূঁইয়া। কোন বৈধতা না থাকলেও ভাড়া দিয়ে সটকে পড়েছেন তিনি। শফিক নামের এক লোক সোনালী ব্রিকসের নাম পাল্টিয়ে পিবিসি নাম দিয়ে ইট তৈরী করছেন। আর সরকারি জায়গা থেকে মাটি কাটায় তাকে একাধিবার নোটিশ করেছে সওজ। জরিমানাও গুনতে হয়েছে। পরে মাসোয়ারায় সব ম্যানেজ। সম্প্রতি হোসেন ভূঁইয়া আবার ওই মিলের ৩ অংশ সরাইলের কুট্রপাড়ার জাফর উদ্দিনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। পানিশ্বর ইউনিয়নে মেঘনা নদীর পাড়ে রয়েছে মেঘনা, পিবিসি, তিতাস ও তৃশা নামের ব্রিকস মিল। এ গুলোর কোন অনুমতি নেই। তাদের নিজস্ব অনুমতিতেই চলছে। স্থানীয় কৃষক ও সাধারন লোকজনের অভিযোগ সকাল বেলা কূঁঁয়াশায় ইট মিলের চিমনির ধূঁয়া অনেক নীচে নেমে আসে। ফলে ফসলি ও বাড়ি ঘরের গাছ পালা মরতে শুরু করেছে। আর ধূঁয়ার ঝাঁজ ও গন্ধে বসত বাড়ির শিশু সহ সকলেরই খুব সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয় শান্তি সমবায় সমিতির সভাপতি মোঃ ইফতেখার আলম বাচ্চু বলেন, ইট মিলের ধূঁয়ায় গ্রামবাসী সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাচ্ছে। মালিকদের অনেক বলেছি। তারা শুনেন না।

এ ছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শাহবাজপুর প্রথম গেইট থেকে রামপুরায় সরাইলের সীমানা পর্যন্ত রয়েছে লাইসেন্স বিহীন অনেক গুলো ব্রিকস মিল। তারা উপজেলা ও জেলায় সবকিছু ম্যানেজ করেই কাগজ ছাড়া ব্যবসা করছেন বলে জানিয়েছেন ভাটা সংশিষ্ট একাধিক ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটা সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা নেয় উপজেলা প্রশাসন। চাঁদাটাই ইটভাটার মালিকদের সকল অনিয়ম দূর্নীতি ঢাকার মূল হাতিয়ার। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাধন কুমার গুহ মজুমদার বলেন,‘ আমার জানা মতে চুড়ান্ত ভাবে শুধু শাপলা ও ইউনিয়ন নামক ২টি ব্রিকস মিলের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। এখানে কৃষি জমির পাশেই অবৈধভাবে অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে ওঠেছে। যার কারণে এলাকার কৃষি আজ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

কৃষি জমির পাশে ইটভাটা হতে পারে না।’পরিবেশ অধিদপ্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন রাজিব সরাইলে ৩৫ টি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন,‘ তাদেরকে একবার জরিমানা করা হয়েছে। অফিসে এসে কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা আসছেন না। শীঘ্রই ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে বড় ধরনের জরিমানা করা হবে।’ সরাইল উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মৌসুমী বাইন হিরা বলেন, সকল তথ্য ভালভাবে জেনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইউএনও সৈয়দা নাহিদা হাবিবা বলেন, এ বিষয়ে খুঁজ খবর নিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিব।

এ জাতীয় আরও খবর