শনিবার, ১০ই মার্চ, ২০১৮ ইং ২৬শে ফাল্গুন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

চুরির অপবাদে এক যুগ শিকলে বাঁধা বাসন্তী

পঞ্চগড় প্রতিনিধি : লক্ষ্মীরহাট বাজার পার হয়ে মহাসড়ক থেকে দক্ষিণে তাকালেই দেখা যাবে বাসন্তীকে। বাড়ির কাছেই একটি কাঁঠালগাছের সঙ্গে পায়ে শিকল দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাঁর মাথার চুলে জটা ধরে গেছে, নাকে তাঁরই বানানো টিনের নাকফুল। কাঠের একটি আসনে বসা বাসন্তীর দৃষ্টি ছুটে ছুটে যাচ্ছে এদিক-সেদিক। কাছে যেতেই বললেন, ‘মোক ছাড়ি দেন, বান খান খুলে দেন, মুই কারো ক্ষতি করু নাই।’

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা ইউনিয়নের লক্ষ্মীরহাট-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার হরিপদ কর্মকারের মেয়ে বাসন্তী রানীকে (৩১) কেন এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, অন্তত ১২ বছর ধরে তিনি শিকলবন্দি। ছেড়ে দিলেই চুরি করেন—স্থানীয় লোকজনের এমন অপবাদ আর অভিযোগের কারণেই এই নারীকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়।

খুব নিচু স্বরে এ প্রতিবেদককে বাসন্তী বলছিলেন তাঁর জীবনবৃত্তান্ত। তাঁর যে মৃগী রোগ আছে সেটাও বাদ যায়নি। কলম দিয়ে খাতায় নিজের নাম ও বাবার নাম লিখে দেন। তাঁর অভিযোগ, সুস্থ মানুষ হলেও তাঁকে সবাই পাগলি ভেবে বেঁধে রেখেছে।

জানা যায়, হরিপদ কর্মকারের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বাসন্তী দ্বিতীয়। তিনি ও তাঁর ছেলে রতন কামারের কাজ করে সংসার চালান। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন বাসন্তী। তারপর আর লেখাপড়া করা হয়নি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মৃগী রোগ ধরা পড়ে তাঁর। পরিবার থেকে বিয়ের চেষ্টা করলেও মানসিকভাবে অসুস্থ ভেবে কেউ তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।

লেখাপড়া ছাড়ার পর বাসন্তী বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের কিশোরীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যাসংক্রান্ত একটি প্রকল্পে চাকরি নেন; কিন্তু রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ শেষ করে বাড়ি ফেরার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এ সময় মৃগী রোগেও কাবু হয়ে পড়েন তিনি।

বাসন্তীর পরিবার জানায়, পাবনায় মানসিক হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বলেছিলেন তাঁর কোনো মানসিক রোগ নেই। অবশ্য ওই সময় রংপুরে মৃগী রোগের চিকিৎসা নেওয়ার সময় তাঁর আচরণ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে। অল্পতেই রেগে যাওয়া, ভাঙচুর করা, গালাগাল করা, মানুষের বাড়ির জিনিস হাতে করে নিয়ে এসে অন্য বাড়িতে রেখে দেওয়া— এসব করতেন বাসন্তী। একদিন লক্ষ্মীরহাট গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন থেকে একটি মোবাইল ফোনসেট চুরি হলে দোষ চাপানো হয় বাসন্তীর ওপর। এ ঘটনায় সালিস বৈঠক হয় এবং সেখানে ঘোষণা দেওয়া হয় যে এলাকায় কোনো চুরি হলেই দায় পড়বে তাঁর ওপর। তাই তাঁকে যেন পরিবারের লোকজন বেঁধে রাখে। যদিও পরে প্রমাণ হয় বাসন্তী ফোনসেট চুরি করেননি। এর পরও আশপাশের বাড়িতে চুরির মিথ্যে অভিযোগে ২০০৬ সাল থেকে তাঁর বন্দিজীবন শুরু হয়। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। এর মধ্যে ২০১৪ সালে মা রুহিলা রানীকে হারান বাসন্তী।

বাবা হরিপদ কর্মকার কালের কণ্ঠকে বলছিলেন, ‘বাসন্তীকে অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখানো হয়েছে; কিন্তু ভালো হয়নি। মাথায় একটু সমস্যা হয়েছে। কর্মকারের কাজ করে যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে। ভালো করে চিকিৎসা করাতে পারিনি। মানুষের অভিযোগের জন্য বেঁধে রাখতে হয়।’ বাসন্তীর ছোটবেলার সহপাঠী ফুলমালা খাতুন বলেন, ‘বাসন্তী খুব ভালো ছাত্রী ছিল। ওরা দুই বোন ফাঁক পেলেই সাইকেল নিয়ে ছোটাছুটি করত। আমরা কখনো কারো বাসায় তাকে চুরি করতে দেখিনি।’

আরেক প্রতিবেশী শিউলি আক্তার বলেন, ‘বাসন্তীকে দিয়ে সকালে ওর ছোট ভাইয়ের বউ কিছু গৃহস্থালির কাজ করিয়ে নেন। ভালো করে কাজ করতে পারে না। তারপর বেঁধে রাখে সারা দিন।’ বাসন্তীর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী পবিত্রা রানী বলেন, ‘ছেড়ে দিলেই ও পালিয়ে যায়, নয়তো বাড়িতে ভাঙচুর করে। তাই বেঁধে রাখি।’

দেবীডুবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি খোঁজখবর নিয়ে শিকল খুলে দেওয়াসহ তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।’

Print Friendly, PDF & Email