বৃহস্পতিবার, ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং ১২ই আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

‘পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে কয়দিন টিকে থাকবেন’

ডেস্ক রিপোর্ট : বগুড়ায় পুলিশি হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী আবার পুলিশের চাপেই মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। এতে করে পুলিশ হেফাজতে অমানুষিক নির্যাতন করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশ নির্যাতনের শিকার মোস্তাফিজার রহমান কিরন বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া বটতলার মৃত সাইফুল আলমের ছেলে। গত ১ জুলাই কিরনের মা পারভীন আক্তার বাদী হয়ে বগুড়া শহরের বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক তরিকুল ইসলামসহ পুলিশ ফাঁড়ির অন্যান্য সদস্যদের আসামি করে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইন-২০১৩ এ অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা করেন।

মামলা সূত্রে জানা যায়, মোস্তাফিজার রহমান কিরন একটি মুদি দোকানে কাজ করতেন। গত ২০ জুন বিকেল ৪টার দিকে বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম তাকে বাড়ি থেকে ধরে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান। এরপর পুলিশ কিরনকে ফাঁড়ির মধ্যে গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করেন। সেদিন রাতে কিরনের মা ও স্ত্রী তাকে খাবার দিতে যান। এ সময় কিরনকে আহতবস্থায় দেখেন তারা। কিন্তু পুলিশের ভয়ে তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি।

এদিকে মা ও স্ত্রী ফাঁড়ি থেকে চলে আসার পর একইভাবে কিরনকে আবারও নির্যাতন করা হয়। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, নির্যাতনের ফলে কিরন অসুস্থ হয়ে পড়লে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসা করায় পুলিশ।

পরের দিন ২০১১ সালের একটি ছিনতাই চেষ্টা মামলায় (মামলা নং-১৯৭ তারিখ-২৯-০৫-১১, জিআর নং-৭২-/২০১৮) জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে কিরনকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিরন জেল হাজতে থাকা অবস্থায় তার মা পারভীন আক্তার জেলা দায়রা ও জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইন-২০১৩ এর ৭ ধারার বিধান অনুসারে পুলিশ কর্তৃক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-০২পি/১৮।

আদালত বাদীর অভিযোগ গ্রহণ করেন এবং ৪ জুলাই শুনানি শেষে এক আদেশে জেলা ও দায়রা জজ উল্লেখ করেন যে শাস্তিযোগ্য অভিযোগের সত্যতা আছে মর্মে প্রতিয়মান হয়। তাই অভিযোগের বিষয়ে একটি মামলা রুজু করার এবং একজন সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা কর্তৃক মামলাটি তদন্ত করার জন্য বগুড়ার পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয়া হয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী থানায় মামলা রেকর্ড করা হয় এবং সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্তবর্তী অভিযোগ তদন্ত শুরু করেন।

এদিকে গত ১১ জুলাই বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন কিরন। ম্যাজিস্ট্রেট শরিফুল ইসলামের আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে কিরন বলেন, ঈদের চারদিন পরে পুলিশ তাকে তার বাড়ি থেকে ধরে আনেন। পরে তাকে বনানী পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার কাছ থেকে অস্ত্র চায় পুলিশ।

কিরন জানান, তার কাছে তো কোনো অস্ত্র থাকার কথা নয়। তখন বনানী ফাঁড়ির ইনচার্জ তারিকুল ইসলাম কিরনকে হাতকড়া অবস্থায় দুই পায়ের হাঁটুতে মারধর করেন। এতে তার ডান হাঁটু মারাত্মকভাবে জখম হয়। এরপর তার পা দুটি ব্রেঞ্চের হাতলে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তারিকুল আসরের নামাজে যাওয়ার আগে কিরনকে ফাঁড়ির গ্রিলের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। এসময় তার হতকড়া খুলে পুলিশের অন্য একজন সদস্য কিরনকে গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। এরপর তারিকুল আবার এসে কিরনকে তার শরীরের পেছন দিক থেকে নির্যাতন করেন। এক পর্যায়ে তরিকুলের কাছে থাকা লাঠি ভেঙে যায়। ওই ভাঙা লাঠির আঘাতে কিরনের শরীরের বিভিন্নস্থান থেকে রক্ত বের হয়। এসময় কিরনের মা তাকে জানালার সঙ্গে ঝুলতে দেখেন। কিরনকে নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে তার মাকেও গালিগালাজ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে আরও নির্যাতন করা হয় কিরনকে। এরপর তাকে মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। জবানবন্দির এক পর্যায়ে আদালতকে তার শরীরের আঘাতের চিহ্নগুলো দেখান কিরন। জবানবন্দীতে বিচারক উল্লেখ করেন, জখমীর শরীর পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ১. তার ডান বাহুতে, কুনইয়ে, কবজিতে, আঙ্গুলের উল্টোপিঠে ও নখে বিভিন্ন মাপের জখমের চিহ্ন রয়েছে। ২. বাম বাহুতে, কনুইয়ে বিভিন্ন মাপের কালশিরা জখমের দাগ রয়েছে। ৩. কোমরের ডান পাশে পেছনে প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ৪. বাম পায়ের গোড়ালি থেকে উরুর নিন্মাংশ পর্যন্ত বিভিন্ন মাপের প্রায় ৮ থেকে ১০ টি কালশিরা জখমের দাগ রয়েছে। ৫. ডান পায়ের হাঁটুতে ব্যান্ডেজ এবং হাঁটুর নিচে পায়ের পেছনে ৩/৪টি জখমের চিহ্ন রয়েছে। ৬. দুই পায়ের পাতায় পানি জমেছে।

শুক্রবার কিরনের বাড়িতে গেলে তার মা পারভীন বেগম ও চাচাতো বোন গুলশানারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করায় কিরনকে পুলিশ বলেছে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। এছাড়াও বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা তাদের বাসায় যান। পুলিশ কর্মকর্তা মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধের পাশাপাশি বলেন পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে কয়দিন টিকে থাকবেন। পুলিশের বিপক্ষে সাক্ষী কোথায় পাবেন? একপর্যায়ে পুলিশের ভাড়া করা সিএনজি চালিত অটোরিকশা যোগে তাদেরকে আদালতে বাদীর আইনজীবীর চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়।

পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তদন্ত করছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সনাতন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, তার তদন্ত কেবল শুরু হয়েছে। এরমধ্যেই বাদী স্বেচ্ছায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। মামলা প্রত্যহারের বিষয়ে বলেন বাদীকে কোনো চাপ দেয়া হয়নি।