মঙ্গলবার, ৬ই জুন, ২০১৭ ইং ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

শূকরের মাংসে ভ্যাট তুলে দিলেন অর্থমন্ত্রী : মানুষকে বোকা বানালেন

AmaderBrahmanbaria.COM
জুন ৩, ২০১৭
news-image

---

মানুষকে বোকা বানানোর প্যাঁচ ভালোই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের লম্বা তালিকা যোগ করে ভ্যাট অব্যাহতির পণ্যসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু অব্যাহতির তালিকায় এমন অনেক পণ্যের নাম ঢোকানো হয়েছে যেগুলো এ দেশের অনেক মানুষেরই জীবদ্দশায় একবারও দরকার পড়ে না।
দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এসব পণ্যের প্রয়োজনীয়তা কতটা সে প্রশ্ন এখন প্রায় সবার মুখে মুখে। গত বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্যদের (এমপি) মধ্যে ‘অর্থ আইন ২০১৭’-এর যে কপি বিতরণ করা হয়েছে, তাতে সুকৌশলে তুলে ধরা হয়েছে করজাল ফেলার কৌশল।
শূকর, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর বা ঘোটকের মাংসে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে শূকরের মাংসে। বাদাম, চিনাবাদামের ক্ষেত্রেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ভ্যাট।
অন্যদিকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বসানো সাবান, শ্যাম্পু, শেভিং আইটেম, মশার কয়েল, অ্যারোসলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষকে ভ্যাট থেকে বাঁচানোর যে চেষ্টার কথা প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, বাস্তবে তাতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে।
কেবল ভ্যাটেই নয়, নির্বাচনের আগের বছরে অর্থমন্ত্রী জনগণের ওপর ঘন করজাল ফেলেছেন, যেখান থেকে চুনোপুঁটিদের রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষও ছাড় পাবে না করের জাল থেকে। তবে সমাজের উচ্চবিত্তসহ রাঘব বোয়ালদের আটকানোর কোনো চেষ্টা লক্ষ করা যায় না প্রস্তাবিত বাজেটে। অর্থমন্ত্রী বাড়তি টাকা আদায় করতে চাইছেন অন্য পেশাজীবীদের কাছ থেকে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ছেলে-মেয়েরা পড়ে, তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ না থাকলেও নানাভাবে ওই সব শিশুর অভিভাবকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার জোরালো চেষ্টা আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও উঠতি মধ্যবিত্তদের আটকানোর সব চেষ্টার কথা দেড়শ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় আড়াল করেছেন অর্থমন্ত্রী।
ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণায় শুভংকরের ফাঁকি: ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিতে গিয়ে বাজেট বক্তব্যে অনেক বেশি মানবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান ১৯৯১ সালের আইনে মাত্র ৫৩৬টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। নতুন আইন কার্যকর করতে গিয়ে ওই সংখ্যা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৩ করা হয়েছে। চাল, ডাল, মুড়ি, চিঁড়া, চিনি ও আঁখের গুড়, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, তরল দুধ, প্রাকৃতিক মধু, বার্লি, ভুট্টা, গম ও ভুট্টার তৈরি সুজি, লবণসহ ৫৪৯টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছেন তিনি। তবে প্রতিটি সবজিকে এখানে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরা হয়েছে। ৯৩ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কৃষি, গবাদি পশু ও মৎস্য চাষ খাতের প্রায় ৪০৪টি ক্ষেত্রে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একেকটি কীটনাশক, আগাছানাশক ও ছত্রাকনাশককে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট অব্যাহতির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে প্রয়োজনীয় পণ্যের সংখ্যা খুবই কম।
অর্থমন্ত্রী যেসব পণ্যকে মৌলিক খাদ্য তালিকায় ফেলে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছেন সেসবের মধ্যে রয়েছে জীবন্ত ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটক, জীবন্ত গবাদিপশু, জীবন্ত ছাগল, ভেড়া, পাতি হাঁস, হংসী, টার্কিসহ বিভিন্ন জীবন্ত পক্ষি, হাঁস-মুরগির মাংস বা নাড়ি-ভুঁড়ি। অব্যাহতির তালিকায় শূকরের মাংসকেই একাধিক পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন—একস্থানে বলা হয়েছে ‘শূকরের মাংস, তাজা, ঠা-া অথবা হিমায়িত (২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত)’, আরেক স্থানে বলা হয়েছে ‘শূকরের মেদবিহীন মাংস অথবা গৃহপালিত পক্ষিগুলোর মেদ (গলানো নহে) তাজা, ঠা-া, হিমায়িত, লবণাক্ত, শুকনা বা ধূমায়িত (২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত)’। আমদানি ও সরবরাহ উভয় পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে ২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত কাঁটা ছাড়ানো মাছ এবং মাছের অন্যান্য মাংস (কিমাকৃত হোক বা না হোক) তাজা, ঠা-া বা হিমায়িত।
ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে মাছের গুঁড়া, যা সাধারণের কাছে অপরিচিত একটি পণ্য। শামুক ও কাকড়া বাদে জলজ অমেরুদ-ী প্রাণী আমদানি-সরবরাহ পর্যায়েও এ সুবিধা রাখা হয়েছে। বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলুর মতো সবজি খোলা বিক্রি হয় অলিতে-গলিতে। এসব পণ্যে ভ্যাট বসানো সম্ভব নয় বলে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এইচএস কোড অনুযায়ী একেকটি সবজিকে একেকটি পণ্য হিসেবে গণনা করে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকা লম্বা করা হয়েছে মাত্র।
তবে সবজির তালিকায় আজগুবি পণ্যও রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে শুকনা শাক-সবজি, জেরুজালেম ডাঁটাগাছ, সাগু তরুমজ্জা, ডুমুর ও গাব। মসলায় আড়াই কেজি পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলেও সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।
ফলে দাম বাড়িয়ে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে ক্রেতাদের বোকা বানানোর চেষ্টা রয়েছে ভ্যাট আইনে। তবুও এমন সব মসলা রয়েছে অব্যাহতির তালিকায়, যার নাম সাধারণের কাছে অপরিচিত। এসবের মধ্যে রয়েছে ফেনেল, জুনিপার, থাইম, জই, বাজরা, ক্যানারাই বীজ, চীনাবাদাম। আরো কিছু পণ্য রয়েছে অব্যাহতির তালিকায়, যা এ দেশে কেউ কেনে কি না সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে; যেমন: সামুদ্রিক আগাছা, লেকোস্ট সিম ইত্যাদি।
আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে কন্দ, কন্দযুক্ত মূল, করসম, ক্রাউন্স, জীবন্ত উদ্ভিদ, প্রাকৃতিক গাম, রজন ও সুগন্ধ বৃক্ষ নির্যাস, শাকসবজির রস, জালি কাঠ, গুঁড়ি, গাছের ডাল, কাঠের গুঁড়ি ও কাঠের বর্জ্য, অমসৃণ কাঠ, গাছের ছাল, চেরাই কাঠ। প্রস্তাবিত বাজেটে সব ধরনের শস্য ও সবজি বীজ, ফলের বীজকে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় রাখা রয়েছে খাদ্যশস্যের খড়কুটা ও খোসা, পশুখাদ্যের জন্য ব্যবহৃত গাছের মূল, চীনাবাদামের খৈল, তুলা বীজের খৈল, তিসির খৈল, সূর্যমুখীর খৈল, সরিষার খৈলসহ বিভিন্ন বীজের খৈলকে একেকটি পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। অব্যাহতির তালিকায় আছে উদ্ভিদের ভুসি, তুষ এবং পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত সবজির অবশিষ্টাংশও।
প্রয়োজনীয় পণ্যে সুবিধা না দিয়ে মানুষের জীবদ্দশায় একবারও দরকার হয় না- এমন পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে তালিকা লম্বা করার কারণ জানতে চাইলে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কোনো উত্তর দেননি। সেখানে উপস্থিত এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানও এ প্রসঙ্গে কিছু বলেননি।
এদিকে বিভিন্ন পেশার মানুষ নানা কাজ করে যে সেবা ফি, চার্জ বা কমিশন পায়, তার ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। প্রশিক্ষণ, কর্মশালায় ক্লাস নিয়ে যে ফি বা সম্মানী মিলবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সেগুলোকেও উৎসে করের আওতায় আনা হয়েছে। ব্যাংকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত রাখা হলে তার মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ এবং আমানতের পরিমাণ ২৫ লাখের বেশি হলে তার মুনাফার ওপর ১২ শতাংশ হারে উৎসে কর বহাল রাখা হয়েছে এবারও। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডেন্টিং এজেন্টের কমিশনের ওপর এখন ৭.৫ শতাংশ উৎসে কর রয়েছে।
ব্যাংকে টাকা জমা বা তোলার ওপর আবগারি শুল্কের হার নিয়ে দুই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে যা বলেছেন, অর্থ আইনে বলা হয়েছে ভিন্ন কথা। ‘এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট অ্যাক্ট ১৯৪৪’-এর ই০৩২.০০-তে ব্যাংকে লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বসানোর কথা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত শুল্কমুক্ত। এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকার বদলে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে এক কোটি পর্যন্ত দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা, এক কোটির বেশি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটির বেশি হলে ১৫ হাজারের বদলে ২৫ হাজার টাকা কাটা হবে।
কিন্তু অর্থ আইন, ২০১৭-এ শুধু পাঁচ কোটি টাকার ওপর জমা ও তোলার ক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকার বদলে ৩০ হাজার টাকা কর্তনের কথা বলা আছে। এ ক্ষেত্রে আর কোনো ধরনের পরিবর্তনের তথ্য নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। অর্থ আইনই এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। তবে বাজেট বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটাতে হলে অর্থ আইন সংশোধন করা হতে পারে।

এ জাতীয় আরও খবর