সোমবার, ২২শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ৭ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

‘সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণে জর্জরিত ফারুক নৌকার প্রার্থী হতে চান’

সারেং বউ, গোলাপী এখন ট্রেনে, লাঠিয়াল, নয়নমনি’সহ দর্শকনন্দিত অনেক ছবি উপহার দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতকে আলোকিত করেছিলেন আকবর হোসেন পাঠান।

ভাবছেন ইনি আবার কে? ইনি বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিশালী অভিনেতা ফারুক।

ছাত্রজীবন থেকেই ফারুক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে জড়ান। এর পর মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন।

তিনি আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী।

চলচ্চিত্রে আসলেন কীভাবে?

এর উত্তর বলতে একটু পেছনে যেতে হবে। ৮/৯ বছর বয়সে মাকে হারাই। পুরনো ঢাকায় মানুষ হয়েছি, বড় হয়েছি। তখন গুলিস্তান সিনেমা হলের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে আসতাম। তখন এটা ছিল ঝোঁপ ঝাড়-জঙ্গল। শুধু প্রেসিডেন্ট হাউসটা বিরাট ব্যাপার। সামনে পার্ক ছিল। পাশে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ আরও কিছু ক্লাব ছিল। ওখানেও যেতাম আমরা।

ঢাকায় বিভিন্ন মঞ্চে নাটক হতো আর আমরা ডিম মেরে নাটক পণ্ড করে দিতাম। এরা আলোচনা করে ঠিক করলো, আমাকে দিয়ে নাটক করাবে। আমি নাটক করলে বুঝতে পারবো নাটক ভেঙে দিলে কেমন কষ্ট হয়। এরপর নাটকও করলাম এক দুটো, কিন্তু পারতাম না কিছুই। ঠিকভাবে ডায়লগও বলতে পারতাম না। আমার ভয় লাগতো। এটা কেমন ভয় বোঝানো যাবে না।

যা-ই হোক, একটা সময় চলচ্চিত্রে অফার পেলাম। এটা কাকতালীয়ভাবেই। প্যারামাউন্ট হোটেলে বসা ছিলাম সেখানে এইচ আকবর সাহেব ঢুকলেন। উনি চলচ্চিত্র পরিচালক। উনিসহ আরও দু’চারজন বসলেন। একজন বলছিলেন, ‘আপনি তো শিডিউল ঠিক করে ফেলছেন যে আগামী মাসে শুটিং করবেন কিন্তু হিরো তো ঠিক করা হয়নি। আপনার হিরো কোথায়?’

তখন এইচ আকবর সাহেব আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমার হিরো ঐ যে বসা’।

আমি তো অবাক, এইটা কি বলে! এর আগে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলছিল বাঁচতে হলে তোমাকে চলচ্চিত্রে যেতে হবে। আমি জানতাম চলচ্চিত্রে ঢোকাটা অতো সহজ না। এই সুযোগ পেয়ে নিজে দৃঢ় হলাম যে, আমাকে এটা করতেই হবে। ছবিটার নাম ছিল ‘জলছবি’। এটাই আমার প্রথম ছবি এবং এখান থেকেই আমার শুরু হল যাত্রা।

আকবর হোসেন পাঠান থেকে ফারুক হলেন কিভাবে?

ফারুক: এই যে এভাবে হলাম!

মানে বলছিলাম আপনার ফারুক নামটা কে দিলেন?

এইচ আকবর সাহেব আর উনারা ৩/৪ মিলে। ঐদিনই, টেবিলে বসেই আমার নাম দিলেন ফারুক। তারা বললেন, আকবর হোসেন পাঠান নামটা একটু বড় হয়ে যায় তাই ফারুক নাম দিলেন। এখন আমি এই নামেই পরিচিত। আমার সবকিছুতেই এখন ফারুক পাঠান নাম।

সারেং বৌ, নয়নমনি, গোলাপি এখন ট্রেনে -আপনার অভিনীত এমন অসংখ্য ছবি তখন সুপারহিট ছিল…

৯০% ছবি সুপারহিট। এটা বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কারো হয় নাই।

তখনকার সময় নিয়ে স্মৃতি কাতরতায় ভোগেন?

না, এগুলো নিয়ে আমার কোনো ইয়ে নাই। আমি তো ভুলেই গেছি। এই ছবিগুলো সব যদি পাওয়া যেত তাহলে সব ছবিগুলো আমি কিনতাম। কিনে ডিজিটাল ফরমেটে ফেলে সিনেমা হলে চালাতাম।

এখন চলচ্চিত্রে আপনাকে দেখা যায় না কেন?

দূরে সরে আছি কথাটা ঠিক না। চলচ্চিত্রে আমি সাংঘাতিকভাবে আছি। যেটা চলচ্চিত্রের পরিবার, সেই পরিবারের কনভেনার আমি। আঠারোটি সংগঠনের কনভেনার আমি। তো আমি চলচ্চিত্রে নাই কি করে!

অভিনয় থেকে দূরে কেন?

হ্যাঁ বলতে পারেন, অভিনয় থেকে দূরে আছি। তখন একটা ব্যাড পলিটিক্স হয়েছে আমার সাথে। অহরহ আমার পেছনে লোক লেগে থাকতো এবং এখনো আছে। যখনই ব্যাড পলিটিক্সটা শুরু হল, এই কারণেই অভিমান করে আমাকে চলচ্চিত্র থেকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।

জাতীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। আপনার এই বর্ণাঢ্যময় জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি আছে বলে মনে করেন?

হা হা হা … অবশ্যই আছে। শুধু অপ্রাপ্তি থাকবে কেন, অভিমানও আছে। আমার সাথে ব্যাড পলিটিক্স করে আমাকে কোথায় নিয়ে গেছে! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই তো পলিটিক্যালি ভিকটিম হয়ে গেলাম আমি। এটাতো কেউ দেখে না। বর্তমান সরকারও খেয়াল করে না যে আমার উপর দিয়ে কী গেছে। শারীরিক নির্যাতন হয়নি- কিন্তু মানসিক, অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে আমাকে চার দলীয় জোটের ভাই সাহেবরা। আমার মতো মানুষ এত কষ্ট করবে কেন? আমার কি কষ্ট নেই? আমার সাথে ব্যাংক যে ব্যবহার করেছে! ২১ আগস্ট নির্মম ঘটনার বিচার হলো, জেল হলো, ফাঁসি হলো এখন কার্যকর করা হবে এই তো! কিন্তু ২১ আগস্ট ঘটার পর থেকে আমার মতো লোককে যে তৎকালীন সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বনাশ করে দিল সেটার বিচার কিন্তু হয়নি। পরবর্তীকালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ঐ একই ধারায় সেই ব্যাংক চলেছে। যদি বলেন কেন, এই কেনোর কোনো উত্তর নেই। তাদের (ব্যাংকারদের) সাহস এতো যে মন্ত্রীদের চিঠিকেও তোয়াক্কা করে নাই। সেই ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আজও আমি ডুবে আছি।

এই ক্ষতিটা কী? কেমন? বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে যদি বলতেন?

এটা হলো ব্যাংকের লোন নিয়েছি আমি কাজ করবো, সেটা চারদলীয় জোট সরকারের সময়। এই জিনিসটা আমার ভুল। আমি মনে করেছি যে, আওয়ামী লীগের সময় যদি যাই, তাহলে সবাই মনে করবে যে আওয়ামী লীগ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছে। আসলে তো আমি অনেক কিছু পাই। আমাকে দেবে না কেন? ২১ আগস্ট নির্মম ঘটনার পরের দিন ২২ আগস্ট আমি, তারানা হালিম, কুমকুম ভাই আমরা কাউকে পাই না, কেউ আসতে চায় না। অনেককে অনুরোধ করতে করতে ২০/২৫ জন লোক আমরা প্রেস ক্লাবের সামনে গেলাম, পুলিশ আমাদের সরিয়ে দিল, তখন হাইকোর্টের ওপাশে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। ২১ আগস্টের ঘটনার পর এই প্রথম মানববন্ধন আমরা করি। এগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। দলকে জানতে হবে, কারা কিভাবে কী করেছে। বহুবার রাজপথে নেমেছি এভাবে। ১৫ আগস্ট আর ২১ আগস্ট আমার কাছে মনে হয়েছে এক সুতোয় বাঁধায়। তাদের চিন্তা ছিল নিশ্চিহ্ন করে দাও এদের। এরকম নিকৃষ্ট ঘটনার পর প্রতিটা লোককে আমি হাসপাতালে দেখতে গিয়েছি। তাদের জানতে হবে একুশে আগস্টের পর কী করেছি, ওয়ান ইলেভেনে কী করেছি, ৭৫ এ কী করেছি। এসব দলই মনে রাখে নাই।

একুশে আগস্টের পর আমি ভূমিকা রাখতে গিয়ে এই কারণেই ব্যাংক আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। পাঁচ হাজার পাঁচ’শ তেত্রিশ কোটি পচাত্তর লক্ষ টাকা তারা আমার কাছে পায় বলে নোটিশ দিয়েছে। যা কথায় লেখা আছে এবং অংকেও লেখা আছে। আমি ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলাম যা খুব অল্প। নিয়েছিলাম ৩৫ কোটি টাকার মতো। কিন্তু আমি প্রজেক্ট করেছি যেটা ২০০ (দু’শত) কোটি টাকার। যেটা কষ্টার্জিত পয়সা দিয়ে। কিন্তু সোনালী ব্যাংক ভুলে হাজার হাজার কোটি টাকার নোটিশ দিয়ে বসে আছে। ভুলেই কেমনে বলি!

আপনি রাজনীতিতে আসলেন কিভাবে?

এর উত্তর বলতে একটু পেছনে যেতে হবে। আউটার স্টেডিয়ামে যখন মিটিং হতো তখন বঙ্গবন্ধুর দরাজ গলায় যে বক্তৃতা শুনতাম, যে কথাগুলো শুনলে মনে হতো এটা আমার কথা। ঐ ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করতাম। রাজনীতি কী তখন বুঝি না। আমার ভাল লাগতো উনার বক্তব্য, উনার কথা বলা।

আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম যে, উনি দেশের মানুষের কথা বলেন, দুঃখী মানুষের কথা বলেন। তখন তাকে ভাল লাগতে শুরু করল। এরপর ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনের সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করি, যদিও আমি কম বয়সি ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সামনে রেখে ছাত্র রাজনীতি শুরু করি।

তখন ঢাকা শহরের মাটিতে আগুন ধরত। ষাটের আগে থেকেই উত্তাল সময় শুরু হয়। আরও বলতে গেলে ৪৮ থেকেই ধীরে ধীরে গুটি পাকাতে শুরু করে। ছেষট্টির ছয় দফার আন্দোলনের কারণে আমার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক নানা ধরনের ৩৭টা মামলা দেয়া হয়।

চারদলীয় জোট সরকারের পর আপনার দল আপনার পাশে দাঁড়ায়নি?

না ভাই, দল আমাকে মূল্যায়ন করে নাই। হয়তো তারা ভুলে গিয়েছিলেন। এবার হয়তো মূল্যায়ন হতে পারে। আর যদি না হয় ভেবে নেব এটা ভাগ্যের খেলা না, শয়তানের হাতের খেলা।

চারদলীয় জোট সরকার আমাকে শারীরিক ভাবে মারেনি, কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে শেষ করে দিয়েছে। এখন আবার ঐক্য করেন যারা তারাই আমার ক্ষতি করেছে। যারা মানুষের ভাল করতে জানে না। কথায় আছে- ভুতের মুখে রাম নাম, তো এখন ভুতের মুখে রাম নাম শুরু হয়েছে।

আচ্ছা এই জাতীয় ঐক্য দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আমি মনে করি না কোনো প্রভাব ফেলবে। তবে হ্যাঁ, আমার কেন যেন মনে হয় একটা সরলমনা শ্রেণির মানুষকে এই ঐক্য ধোঁকা দিতে পারে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

এটা ডিপেনড করবে। আমার মনে হয় যে আমার চাওয়ার অধিকার আছে।

কোন আসন থেকে প্রার্থী হতে চাচ্ছেন?

এটা হলো গাজীপুর-৫। এটা আমার বাপ-দাদার ভিটা। দল থেকে আমি কখনো কোনো অ্যাডভানটেজ নেইনি বা আমাকে দেয়া হয় নাই। এবার অবশ্যই আমার পাওয়া উচিত। আর কবে পাবো! বয়স তো কম হয় নাই। কদিন পর তো আমার সত্তর হবে।

সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, শুভকামনা ।

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
সূত্র:পরিবর্তন

এ জাতীয় আরও খবর