মঙ্গলবার, ৬ই জুন, ২০১৭ ইং ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

দিনে রোজা, রাতে ক্ষুধা

AmaderBrahmanbaria.COM
জুন ৫, ২০১৭
news-image

---

অনলাইন ডেস্ক : ফাতিমা সালাহ। বয়স ৫৮। রমজান মাসে অনেকে এক দিনে একটু ঘুমিয়ে নেন, কিন্তু তিনি তা পারেন না।

এর পরিবর্তে তাকে ছুটতে হয় সানা শহরে বিভিন্ন প্রতিবেশীর বাড়ি ও দোকানে। রাতে তার পরিবারের জন্য ভালো খাবার জোগাড়ের আশায় ঘুরতে হয় তাকে।

জলভরা চোখে ফাতিমা বলেন, ‘হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্লান্ত ও পিপাসার্ত থাকি এবং ভালো সেহরি ছাড়াই রোজা রাখি।’

‘মান-সম্মান নিয়ে বাড়িতে থাকতাম আমি এবং রমজান আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মাস। কিন্তু এই যুদ্ধ প্রতিদিন আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে। গত রমজানে সব ঠিকঠাক ছিল কিন্তু এবার খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দিনে রোজা রাখি এবং রাতে অনাহারে থাকি।’

মুসলিম বিশ্বে রমজান মাস আনন্দপূর্ণ ও ধর্মীয় সময় হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে এই মহান দিনগুলোতে শুকরিয়া গোজারের কোনো স্থান নেই।

সম্প্রতি জাতিসংঘ হুঁশিয়ার করেছে, ইয়েমেনে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে। এ জন্য তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জরুরি ত্রাণ সহায়তা চেয়েছে।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ অনেক ইয়েমেনি পরিবারকে দারিদ্র্য ও হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।

ফাতিমা বলেন, ‘এখন রমজান মাস এবং আমি আপাদমস্তক দারিদ্র্যে ডুবে আছি… আমার পরিবারের জন্য খাদ্য দরকার এবং বাড়ি ভাড়া বাবদ আমাকে ২০ হাজার রিয়াল (ইয়েমেনি) পরিশোধ করতে হবে।’

এ বছর রমজান মাস এমন সময় পড়েছে, যখন মহামারির মতো ভয়াবহভাবে ইয়েমেনজুড়ে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, এপ্রিল মাস পর্যন্ত কলেরায় মারা গেছে ৫৩০ জন এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রায় ৬৫ হাজার লোকের কলেরা হয়েছে।

মোহামেদ আল-মোখদারি। ১০ সন্তানের বাবা। পরিবার নিয়ে সানায় বসবাস করেন। তিনি জানান, হাজার শুকরিয়া, তার সন্তানরা কলেরায় আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে এই পবিত্র মাসে ইয়েমেন যে পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, সেজন্য তিনি অসুখী।

আলতোভাবে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মোখদারি বলেন, ‘রমজান একটি বিশেষ মাস। কিন্তু আমি কোনো সন্তোষ অনুভব করতে পারছি না, যেমনটি পারতাম যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আগে… এখন এখানে খাদ্যদ্রব্যের দাম খুবই চড়া এবং আয় করাও খুব কঠিন।’

পরিস্থিতির সঙ্গে টিকে থাকতে মোখদারির দুই ছেলে এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্লাস্টিকের বোতল কোড়ায় এবং রিসাইক্লিং কারাখানায় বিক্রি করে। এতে দিনে দুই-এক ডলার আয় করতে পারে তারা। মোখদারি নিজে বেকার এবং তার পরিবার ভালো ইফতারের বন্দোবস্ত করতে পারে না। তারা প্রতিদিন ইফতার করে বড়জোর দই ও রুটি দিয়ে।

মোখদারি বলেন, এটি খুবই কঠিন। ভাত, রুটির মতো অপরিহার্য খাবার আমরা পাই না বললেই চলে। এই রমজানে মাংস, মুরগি, পর্যাপ্ত শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া যেন স্বপ্নের মতো।’ তিনি আরো বলেন, ‘সেসব দিন চলে গেছে, যখন প্রতিটি ইয়েমেনি পরিবারের মতো আমার বাড়িতেও রজমানে ছিল অন্যরকম আনন্দ।’

সানার এক মুদি দোকানের মালিক আবদুল লতিফ আল-হুবাইশি। বললেন, ‘এই রমজানে তার দোকানের মালপত্রের কাটতি খুবই কম। গত বছরের তুলনায় এবার চাহিদা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই অর্ধেকও আবার আসে শুধু চিনি, আটা ও চাল কিনতে। মিষ্টি, বাদাম, শাকসবজির মতো সামগ্রীর চাহিদা নেই বললেই চলে। কারণ লোকজন শুধু মৌলিক চাহিদাই মেটাতে পারছে।’

তিনি জানান, গত বছর রমজানে মাকেরটে যেসব দোকানদার পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, এবার আর তাদের দেখা নেই। কারণ অধিকাংশ পরিবারের প্রয়োজনমতো কেনাকাটার অর্থ তাদের হাতে নেই।

আল-হুবাইশি আরো বলেন, ‘এমন রমজান তারা কখনো দেখেননি। যুদ্ধের মধ্যে এটি তাদের তৃতীয় রজমান। এবারই সবচেয়ে কঠিন, কারণ গত নয় মাস সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন আটকে আছে। সারা বছরের মধ্যে রমজানে ইয়েমেনের মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু এ বছর ব্যয় করার মতো কিছুই নেই তাদের হাতে।’

ইয়েমেনি অর্থনীতিবিদ সাইদ আবদুল মোমিন এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, এ বছরের অবস্থা খুবই করুণ। তিনি বলেন, বেতন দেওয়া হচ্ছে না, দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশচুম্বী এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ইয়েমেনি মুদ্রার ধারাবাহিক দর পতনে পরিস্থিতি আরো নাজুক হচ্ছে। ডলারের বিপরীতে ইয়েমেনি রিয়ালের ক্রমেই দর পতন দ্রব্যমূল্য বাড়াচ্ছে- এটি দেশের গরিব মানুষের যন্ত্রণার একটি উৎস।

রমজান এক মাস পরে থাকবে না। কিন্তু ইয়েমেনের এই দুঃসময় কবে শেষ হবে, তার উত্তর আছে কি কারো কাছে?