মঙ্গলবার, ২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ইং ৮ই ফাল্গুন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

৮০৩২ রোহিঙ্গার তালিকা গেল মিয়ানমারের হাতে

মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা ঢাকা সফররত দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল খ শোয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

শনিবার সচিবালয়ে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়।

বৈঠক শেষে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সাড়ে ১০ লাখের বেশি মিয়ানমার নাগরিকের তালিকা করা হয়েছে।

“বৈঠকে তাদের কাছে এক হাজার ৬৭৩টি রোহিঙ্গা পরিবারের আট হাজার ৩২ জনের তালিকা দিয়েছি।”

ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তাদের পরিচয় যাচাই করার কথা মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলেছেন বলে জানান তিনি।

কবে থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে তার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। তবে অগ্রবর্তী দল হিসাবে দুই দেশের সীমান্তের ‘শূন্য রেখায়’ অবস্থানরত সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ‘শিগগির’ ফেরত নেওয়ার আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা যাতে নিজেদের এলাকায় ফিরে যেতে পারেন সে বিষয়ে আলোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক সেদেশে যাবেন।

“সেখানে জেলা প্রশাসক পর্যায়ে মিটিং হবে।”

আর বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা এই বৈঠকে যে তালিকা দিয়েছেন তা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া দ্রুত শুরুর আশ্বাস দিয়েছেন মিয়ানমারের কর্মকর্তারা।

“তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে নিয়ে যাবেন। তাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে দুইপক্ষের ঐক্যমত রয়েছে।”

কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের ওপর গত ২৫ অগাস্ট নতুন করে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরু হলে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে তারা। এই কয় মাসে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আগে বিভিন্ন সময়ে আসা আরও চার লাখের মতো রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ।

এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্মতিপত্র সই হয়। এর ভিত্তিতে দুই দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।

জানুয়ারির শেষ দিকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যায়।

১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে বৃহস্পতিবার তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ শোয়ে। রাতেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। সেখানে আলোচনায়ও পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তার তার দেশের ‘আগ্রহের’ কথা জানান মিয়ানমারের এই সেনা কর্মকর্তা।

শুক্রবার বেলা পৌনে ৩টায় মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে উপস্থিত হলে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনের সামনে তাকে সশস্ত্র সালাম জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল। পরে ৩টার দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বৈঠক শুরু হয়। বাংলাদেশের পক্ষে মন্ত্রীসহ ১৮ জন এবং মিয়ানমারের পক্ষে ১৫ জন বৈঠকে অংশ নেন।

সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে বৈঠক শেষ হওয়ার পর মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল সচিবালয় ত্যাগ করেন। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনায় ‘খুব আন্তরিকতা’ দেখিয়েছেন মিয়ানমারের কর্মকর্তারা।

“তারা বলেছেন, ক্রমান্বয়ে এগুলো নিয়ে যাবেন। বলেছেন, যেই এলাকাটিতে তারা (রোহিঙ্গারা) থাকেন সেটা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। এই এলাকায় তারা একটা পরিকল্পনা (প্ল্যান) করছেন। এদেরকে রাখার জন্য তারা একটা ভিলেজ ডেভেলপ করবে।”

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন-পুনর্বাসনে তিন ধাপে কাজ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমিক, মাধ্যমিক এবং ফাইনাল পর্যায়ে পুনর্বাসনের জন্য কাজ করবে তারা। প্রথমিক কাজ হচ্ছে, এদের চিহ্নিত করা হবে, দ্বিতীয় পর্যায়ে পুনর্বাসনের জন্য বাড়ি-ঘরের ব্যবস্থা করা এবং তৃতীয় পর্যায়ে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পর যেন স্থায়ীভাবে থাকতে পারে।”

রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার পর যাতে অনুকূল পরিবেশ পায় তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ দফা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে তাদের বলা হয় বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল।

“তারাও এগুলো স্বীকার করে ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা করার কথা বলেছে।”

এখনও রোহিঙ্গা আসার বিষয়টি আলোচনায় উঠেছিল কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “এখনও দিনে ৫০-১০০ এভাবে লোক আসছে, এটাও আমরা বলেছি। তারা সব কিছু স্বীকার করেছেন, বলেছেন- এগুলো তারা বন্ধ করার প্রচেষ্টা নেবেন।”

বৈঠকে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক ঘন ঘন করার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে জানিয়ে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আমাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তারা খুবই পজিটিভ মুডে ছিল।

“ফেজ বাই ফেজ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের কথায় আমরা বিশ্বাস করতে চাই,  আমাদেরও আস্থা আসছে হয়ত তারা (রোহিঙ্গাদের) নিয়ে যাবে।”

ইয়াবা চোরাচালান ও সীমান্ত হত্যা বন্ধের আহ্বান

বৈঠকে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা চোরাচালান বন্ধের তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন।

আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল  বলেন, “ইয়াবা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, তাদের দেশ থেকে যে ইয়াবা আসছে সে কথা, যাতে ইয়াবা আসা বন্ধ হয়। ৪৯টি কারখানার নাম দিয়েছি যেখানে ইয়াবা তৈরি হয়। তারা আমাদের বলেছেন, এই কারখানা তারা বন্ধ করার চেষ্টা করবেন।

“তারা আমাদের অনুরোধ করেছেন যেন আমরাও তাদের সঙ্গে কাজ করি, এই ইলিসিট ড্রাগ বন্ধ করার জন্য। এই ব্যাপারে দীর্ঘ সময় আলাপ করেছি।”

এছাড়া সীমান্ত হত্যা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

সীমান্তে যে কোনো সমস্যায় তাৎক্ষণিক আলোচনার জন্য বর্ডার লিঁয়াজো অফিস করার বিষয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এটার অগ্রগতি হয়েছে এবং এটা হবে।”

বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম ইউনিটের সচিব খোরশেদ আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পটোয়ারী, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক আওরঙ্গজেব চৌধুরী, বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ রেজওয়ান, ডিজিএফআই’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন, পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শহীদুল ইসলাম, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমদে, জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সামছুর রহমান, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম চৌধুরী, মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাশেদুল মান্নান ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক এম মনিরুল ইসলাম।

মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব উ টিন মিন্ট, পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থো, পুলিশ প্রধান মেজর জেনারেল অং ইউন অ, বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লইন অ-সহ ১৫ জন সদস্য।

Print Friendly, PDF & Email