রবিবার, ২৯শে জুলাই, ২০১৮ ইং ১৪ই শ্রাবণ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

হানিফ পরিবহনের চালক-সুপারভাইজারের এ কেমন নৃশংসতা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট। নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় ‘প্রসাব’ পেয়েছে বলে থেমে থাকা হানিফ পরিবহনের বাস থেকে নেমেছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল। এর মধ্যেই যানজট কিছুটা ছাড়লে বাস এগোতে থাকে। পায়েল দৌড়ে এসে বাসে উঠতে গিয়ে নাকেমুখে আঘাত পান। রক্ত বের হতে থাকে। আহত যাত্রীকে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে বাসটির চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারী মিলে একটি ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেন। দুর্ঘটনার দায় এড়াতে বাসকর্মীরা এমন কাজ করেন বলে বাসটির সুপারভাইজার মো. জনি বুধবার মুন্সিগঞ্জের আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন তথ্য জানান জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম।

গত ২১ জুলাই রাতে দুই সহপাঠীর সাথে চট্টগ্রাম মহানগর থেকে হানিফ পরিবহনের বাসে চড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএর পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী পায়েল। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। সকালে পায়েলের মোবাইল ফোনে কল দেন তার মা কোহিনূর বেগম। ফোন ধরেন বাসে থাকা তার বন্ধু। পায়েল নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পেরে পরিবারের সদস্যরা বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর ২৩ জুলাই সোমবার সকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবের চর খাল থেকে পায়েলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার বাসের সুপারভাইজার মো. জনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সুপারভাইজার জনি জানান, শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে হানিফ পরিবহন (ঢাকা মেট্রো-ব-৯৬৮৭) শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে করে পায়েল ও তার দুই বন্ধু মো. মহিউদ্দিন শান্ত (২২) ও হাকিমুর রহমান আদর (২২) চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়।

‘প্রসাব’ পেয়েছে বলে মোবাইল বাসেই রেখে মহাসড়কের ভাটেরচর ব্রিজের কাছে গাড়ি থেকে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পায়েল। রাস্তায় তখন যানজট ছিলো। যান চলাচল কিছুটা শুরু হলে চালক জামাল হোসেন (৩৫) গাড়ি সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। এসময় পায়েল দৌঁড়ে গাড়িতে উঠতে গেলে চালক দরজা খুলে তাকে উঠানোর চেষ্টা করে।

একপর্যায়ে ওই ছাত্র দরজার সঙ্গে ধাক্কা লেগে মুখে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে রাস্তায় পড়ে যান। তখন সুপারভাইজার জনি (৩৮), চালক জামাল হোসেন (৩৫), বাসের সহকারী (হেলপার) ফয়সাল হোসেন (৩০) পায়েলকে মৃত ভেবে ভাটেরচর ব্রিজ থেকে খালে ফেলে দেন। পায়েল বাস থেকে নামার সময় তার পাশে থাকা বন্ধু ঘুমিয়ে ছিলেন ও আরেকবন্ধু শেষের সিটে ঘুমিয়ে ছিলেন।

পায়েলের বন্ধু মহিউদ্দিন শান্ত জানান, ঢাকায় প্রবেশের সময় ঘুম থেকে উঠে পায়েলকে না দেখেতে পেয়ে সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাস করা হয়। তিনি জানান— ‘পায়েল প্রসাব করতে নেমে আর গাড়িতে উঠতে না পারায় পরের গাড়িতে আসবে।’ এতে সন্দেহের সৃষ্টি হলে পায়েলের স্বজনদের বিষয়টি জানানো হয় বলেও জানান মহিউদ্দিন।

চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানার সরিষপুর গ্রামের গোলাম মাওলার ছেলে পেয়েল। ঢাকার একটি আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন। সোমবার ভাটেরচর ব্রিজের নিচে সকাল ৯টার দিকে পানিতে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জানা যায়, খালে ফেলে দেওয়া পায়েল তখনো জীবিত ছিলো। কারণ তার পেটে প্রচুর পরিমাণ পানি ছিলো।

মঙ্গলবার পায়েলের মামা গোলাম সারোয়ারদী বিপ্লব বাদী হয়ে গজারিয়া থানায় হানিফ পরিবহনের ওই বাসের চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীকে এজাহার নামীয় আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই বাসের চালক জামাল ও সহকারী ফয়সালকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রেস ব্রিফিংয়ে এসপি জায়েদুল আরো জানান, গ্রেপ্তার চালক জামাল ও সহকারী ফয়সাল দু’জনই আপন ভাই। তাদের দু’জনকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মরদেহ গুমের বিষয়েও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাস সংশ্লিষ্টদের এই রকম আচরণ মোটেও কাম্য নয়। আঘাত প্রাপ্ত পায়েলকে তাৎক্ষণিক স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে হয়তো বাঁচানো যেতো বলেও জানান পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।