বৃহস্পতিবার, ৬ই জুলাই, ২০১৭ ইং ২২শে আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

১৮ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার সম্পূরক বাজেট পাস

AmaderBrahmanbaria.COM
জুন ৬, ২০১৭
news-image

---

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ১৮ হাজার ৩৭০ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পূরক বাজেট পাস করেছে সংসদ। গত বাজেটে বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত খরচের ব্যয় সমন্বয়ের ২৬টি দাবির বিপরীতে সংসদ এসব খরচের মঞ্জুরী অনুমোদন দেওয়ার পর ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল’ বা সম্পূরক বাজেট পাস হয়। এর মাধ্যমে ২৭টি মন্ত্রণালয়ের ৫৯টি বিভাগ-এর অতিরিক্ত ব্যয় অনুমতি হলো।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মঙ্গলবার সংসদের বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০১৭’ পাসের প্রস্তাব করেন। পরে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস। সম্পূরক বাজেটের উপর বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ১৪৯টি ছাঁটাই প্রস্তাব কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়।

সংসদে উত্থাপিত ২৬টি মঞ্জুরি দাবির মধ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাকি মঞ্জুরি দাবিগুলো সরাসরি ভোটে প্রদান করা হয়।

সম্পূরক বাজেটে সবচেয়ে বেশি মঞ্জুরী দেওয়া হয়েছে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন বিভাগ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগকে। এ খাতে মোট ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। আর সবচেয়ে কম ৭০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা মঞ্জুরী দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে ৩৮৭ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এছাড়া বাড়তি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২ হাজার ১৪৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ২ হাজার ৫৫ কোটি ২১ লাখ ৭ হাজার টাকা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক হাজার ৮০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অনুকূলে এক হাজার ১৬৬ কোটি ৭৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা।

এদিকে বাজেট পাসের সময় এক মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অন্য মন্ত্রীর প্রস্তাব উপস্থাপনের কড়া সমালোচনা করেন ছাঁটাই প্রস্তাব দেয়া এমপিরা। তারা বলেন, এখানে বাজেট পাস হচ্ছে। খুবই গুরুত্বপূর্ন বিষয়। অথচ অনেক মন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে অনুপস্থিত। এক মন্ত্রীর পরিবর্তে অন্য মন্ত্রী তার প্রস্তাব তুলে ধরছেন। এটা দুঃখজনক।

এদিকে সম্পূরক বাজেট পাসের আগে এ নিয়ে আলোচনা করেন সরকারি ও বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র এমপিরা। তারা অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের কড়া সমালোচনা করেন। এমপিরা বলেন, যখন বাজেট করা হয় তখন কোন হিসাব করে করা হয়েছিলো? কারা সেসময় বাজেট তৈরি করেছিলেন? ব্যয় বরাদ্দের বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, সেলিম উদ্দিন, স্বতন্ত্র এমপি রুস্তম আলী ফরাজী, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর ও নূরুল ইসলাম মিলন। তবে কাজী ফিরোজ রশীদ ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে অপরাগতার কথা জানান। সম্পূরক বাজেটের ওপর দুই দিনে ১৫ জন এমপি বক্তব্য রাখেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত বরাদ্দের বিরোধিতা করে এমপিরা বলেন, প্রতিবছর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এসব অর্থ কোন খাতে ব্যয় হয়, সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না- তা বিস্তারিতভাবে জানানো হয় না। জনগণের অধিকার রয়েছে এই খাতে বরাদ্দের টাকা স্বচ্ছভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না। প্রতিরক্ষা খাত হচ্ছে জনগণের খাত। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই।

বক্তব্যে তারা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে বলেন, মন্ত্রণালয় ব্যর্থ না হলে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হতো না। প্রতি বছরই এ মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দাবি করে। অথচ তাদের খরচের খাত সুনির্দিষ্ট।

জবাবে সংসদকার্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, প্রতিরক্ষা খাতের জন্য যে টাকা চাওযা হওয়া তা অত্যন্ত যৌক্তিক। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কি কাজ করছেন,তাদের জন্য কি কি কেনা হচ্ছে তা এরইমধ্যে সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে একাধিকবার বলা হয়েছে। এখন কেউ যদি জেনেও না জানার ভান করেন তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আমাদের সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের জন্য যে সম্মান বইয়ে আনছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। তাই ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত খাতে বরাদ্দের বিরোধিতা
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এর বিরোধিতা করে এমপিরা বলেন, সাড়ে তিন বছরে কোন এমপিকে রাজধানীতে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অথচ অর্থমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন প্লট বরাদ্দ দেবেন। এর মধ্যেই আমাদের সামনে এত বিপুল অংকের টাকা বরাদ্দ চাওয়া হযেছে। এ মন্ত্রণালয়ের সেবা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। মানুষকে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সংসদ সদস্যদের আবাসনের সুবিধাই এ মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করতে পারেনি। অনেক মন্ত্রীরা জানেনই না যে তার মন্ত্রণালয়ে এই অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। তারা আসলে নিজেরাও বলতে পারবেন না কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে। রাজউকের মাধ্যমে এ মন্ত্রণালয় অনেক কাজ করে। আসলে রাজউক হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া। দুর্নীতির দায়ে কেউ কেউ এখন জেলও কাটছেন।

জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ৫ জন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মূল কথা হলো সংসদ সদস্যরা প্লট চায়। এটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবার বক্তব্যে একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হিসেবে বলা হয়েছে, ঢাকায় এমপিদের প্লট দেয়া হয়নি। পাশাপাশি তারা বলেছেন, সারাদেশে আবাসন সমস্যার সমাধান করা। আমরা এরইমধ্যে সারা দেশে আবাসন সমস্যার সমাধানে কাজ করছি। আবাসন খাতে সরকার সামান্য ভূমিকা পালন করে। বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করে। তারা এদিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। দেশের আবাসন সমস্যা একটা বিরাট সমস্যা। এ সমস্যা সমাধান শুধু সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। বেসরকারি খাতেরও সহযোগিতা লাগবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় খাতে বরাদ্দের বিরোধিতা
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ৯২৭ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দের বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাবকারী ৬ এমপি বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয় এটা। অনেক অঞ্চলে দেখা যায় ৪/৫টা প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, এসব প্রকল্পের কাজ হয় না। যোগাযোগ করলে বলা হয় হবে হবে হবে। তারা বলেন, অতিরিক্ত যে টাকা নেয়া হয়েছে তার ব্যয় যেনো সঠিকভাবে হয় সে বিষয়ে মন্ত্রীকে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।

জবাবে এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এটা একটি উন্নয়নমুখী বিভাগ। প্রতিনিয়ত সড়কের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে। সুপেয় পানিসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার বিভাগ এখনও আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। দেশের জনগণ ও জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ খাতে বরাদ্দের বিরোধিতা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ চাওয়া ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দের বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব দেন ৬ এমপি। এসময় তারা বলেন, এটি একটি নতুন সৃষ্ট বিভাগ। এখানে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য খাতেও বেশি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বিগত সময়ে একটি মাদ্রাসাও অধিভূক্ত হয়নি। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি। কারিগরি শিক্ষার প্রতি মানুষ নিরুৎসাহিত। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগকে কিভাবে এক করা হলো? দুটি তো ভিন্ন বিষয়। এছাড়া কোন কোন প্রকল্পর জন্য অতিরিক্ত টাকা চাওয়া হয়েছে তা বলা হয়নি।

জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তে কারিগরি ও মাদরাসাকে একটি বিভাগে আনা হয়েছে। এসময়ে এই দুটি শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সরকার কাজ করছে বলেই বেশি টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। যার কারণে আজ সম্পূরক বাজেট পাস করানো হচ্ছে। যারা বলছেন, মন্ত্রীরা জানেন না কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। একটি প্রকল্প তৈরি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক ধাপ পার হয়ে একটি প্রকল্প পাস হয়। সরকার ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত করেছে।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংযুক্ত তহবিলের উপর দায়যুক্ত সম্পূরক ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং ২০১৭ সনের ৩০ জুন সমাপ্য অর্থ বছরে সরকারের অনুমিত ব্যয় সম্পর্কে সংসদ প্রদত্ত মঞ্জুরীসমুহের বিপরীতে সংযুক্ত তহবিল হতে প্রয়োজনীয় অর্থ নির্দিষ্টকরণের বিধান করতে এ বিল আনা হয়েছে। আগামী ৩০ জুন সমাপ্য চলতি অর্থবছরের কার্যাদি নির্বাহের জন্য সংযুক্ত তহবিল থেকে মঞ্জুরিকৃত অর্থের অধিক অর্থ প্রদান ও নির্দিষ্টকরণের কর্তৃত্ব প্রদানের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মঙ্গলবার সংসদে ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০১৭’ উত্থাপন করেন।